ঢাকা: একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাকে দ্বিতীয়বার প্রমাণ দিতে হলো যে তিনি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন! লজ্জার বাংলাদেশ!
‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ সাড়া জাগানো গানের গীতিকার এবং গায়ক আপেল মাহমুদ বীর মুক্তিযোদ্ধা কিনা সেটা ওনাকে প্রমাণ দিতে হল স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরে এসেও!
শুধু গান গেয়ে নয়, তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন।
ভাগ্য ভালো যে তিনি বেঁচে ছিলেন। না হলে হয়তো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কালিমা লেপন হতো তাঁর নামের আগে। অবশ্য সেটা হলেও হয়তো কেউ অবাক হতেন না!
বিশিষ্ট গীতিকার আপেল মাহমুদ। তাঁকে আবারো প্রমাণ করতে হলো তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। কুমিল্লার কৃতি সন্তান তিনি, কুমিল্লা জিলা স্কুল ১৯৬২ ব্যাচ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আপেল মাহমুদ বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। যার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে সাহস সঞ্চয় করতেন, যিনি তিন নম্বর সেক্টরে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন- তাঁকে আবার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের শুনানিতে উপস্থিত হয়ে প্রমাণ দিতে হলো তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা!
আপেল মাহমুদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” গানের গায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
এ ছাড়াও “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর” তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য গান। দেশাত্ববোধক গান তো বটেই, তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, লালনগীতি, গণসঙ্গীত ও আধুনিক ধারার গানও গেয়েছেন।
সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি ২০০৫ সালে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন।
কিন্তু কে আর মনে রাখে মুক্তিযোদ্ধার কথা! এখন বাংলাদেশে রাজাকার, জামায়াতে ইসলামীর সময়!
সম্প্রতি আপেল মাহমুদের মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় নিয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে (জামুকা) অভিযোগ করেন এক ব্যক্তি।
সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সোমবার বিকালে কুমিল্লা সার্কিট হাউসে জামুকার শুনানিতে হাজির হন তিনি। প্রমাণ দেন, তিনি আসলেই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর স্বাধীন বাংলা বেতারকর্মী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মনোয়ার হোসেন আপেল মাহমুদের বিরুদ্ধে জামুকায় অভিযোগ করেন।
গুরুতর অভিযোগ করা হয় যে আপেল মুক্তিযোদ্ধা নন । এর প্রেক্ষিতে গত ১২ মে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের উপপরিচালক (উন্নয়ন) ফাতেমা খাতুন আপেল মাহমুদকে নোটিশ করেন।
আপেল মাহমুদকে সমস্ত দলিল ও সাক্ষ্য উপস্থাপনের জন্য বলা হয়।
বাংলাদেশের জন্য এটি আরো একটি কালিমালিপ্ত অধ্যায় হয়ে থাকলো।
জামুকার মহাপরিচালক শাহিনা খাতুন বলেন, ‘আপেল মাহমুদ যথাযথভাবে প্রমাণ করেছেন তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তিনি যদি শুধু গান গেয়ে উদ্বুদ্ধ করার মতো ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতেন তাহলে সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব পেতেন।
কিন্তু, কাগজপত্রে প্রমাণ করেছেন তিনি অস্ত্র হাতে একাত্তরের মাঠে যুদ্ধ করেছেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
আপেল মাহমুদ বলেন, ‘জীবিত থেকেই দ্বিতীয়বার প্রমাণ করতে হয়েছে আমি মুক্তিযোদ্ধা। বিষয়টি নিয়ে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সদস্যরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।’
আরও বলেন, ‘মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের কমান্ডে আমি তিন নম্বর সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধ করেছি। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত আমরা নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেছি।
নরসিংদী থেকে আমরা চলে যাই ক্যাপ্টেন নাসিমের আন্ডারে আশুগঞ্জে। সেখানে আমরা ভৈরব রামনগর ব্রিজে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করি।
সেখান থেকে রামনগর ব্রিজ, ভৈরব, আশুগঞ্জ, হবিগঞ্জ, চুনারুঘাট, চানপুর টি স্টেট, তেলিয়াপাড়া টি স্টেটে যুদ্ধ করেছি।
তেলিয়াপাড়া ১৯৭১ সালে আমার শেষ যুদ্ধক্ষেত্র ছিল। আশুগঞ্জের যুদ্ধের সময় আমার বাঁ চোখের পাশে আঘাত লাগে।’
আপেল মাহমুদ বলেন, ‘সেখান থেকে আমাকে আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আবদুল জব্বার ভাইও আসেন। ২৫ মে কলকাতায় বড় করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
শুরুতেই আমাকে ও জব্বার ভাইকে শরণার্থীদের জন্য একটি অনুষ্ঠান করতে হয়েছে।
আমরা দুদিন অনুষ্ঠান করে অনেক শিল্পী পাই। ১ জুন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমার ওপর যে দায়িত্ব ছিল তা ২০০৬ সালে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত পালন করেছি।’
অভিযোগ দাতার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদ বলেন, ‘আমি তো মনোয়ার হোসেনের কোনো ক্ষতি করিনি। জানি না তিনি কেন এমন করলেন।
তার ভিত্তিহীন অভিযোগের কারণে বেঁচে থাকা অবস্থায় আমাকে প্রমাণ করতে হয়েছে যে আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।’