বাংলাদেশে মানবাধিকারের বালাই নেই। তাই শতাধিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে আটকে রাখা হয়েছে জেলে।

উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কানাডার গবেষণা সংস্থা ‘গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্নেন্স’ বা জিসিডিজি।

জুন মাসের শুরুতে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে তারা অভিযোগ করেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় থেকে ২৭ মে পর্যন্ত ১০৮ জন নির্বাচিত জাতীয় সংসদের সদস্যকে গ্রেপ্তার করে জেলে বন্দি রাখা হয়েছে।

অথচ, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই। বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাতেই তাঁদের গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

প্রায় ১০ মাস ধরে জেলবন্দি এই জনপ্রতিনিধিদের অনেককেই বিনা কারণে আটকে রাখা হয়েছে।

হাইকোর্ট তাঁদের মুক্তি দিলেও অন্য মামলায় ফের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও কানাডার এই গবেষণা সংস্থা তাঁদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে।

গত বছর ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার পর যেভাবে জাতীয় সংসদ সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাতে পশ্চিমি দুনিয়া অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত।

সেটাই ধরা পড়েছে কানাডার এই গবেষণা সংস্থা জিসিডিজির প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নামে যেভাবে শেখ হাসিনার সরকারকে উতখাত করা হয়েছে তাতে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা গুলি।

জিসিডিজির দাবি, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনেরও অবিলম্বে বাংলাদেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত।

তাঁদের প্রতিবেদনে, বিনা বিচারে ১২ জন নারী-সহ ১০৮ জন এমপির গ্রেপ্তারের কড়া সমালোচনা করা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১২ জন নারী সংসদ সদস্যাকেও আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই আটক করে রাখা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার শর্তও মানেনি ড. ইউনূসের সরকার।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাত্র ৭ জন এমপি মুক্তি পেলেও বাকিদের অযথা আটকে রাখা হয়েছে।

অথচ, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ধৃতেরা সকলেই মুক্তির দাবিদার।

কারণ কারও বিরুদ্ধেই নেই অপরাধের কোনও সুনির্দিষ্ট বা গ্রহণযোগ্য অভিযোগ। ১০১ জন সংসদ সদস্যের জামানত বারবার অস্বীকার করা হয়েছে।

তাঁদের ওপর মানসিক অত্যাচার চালাচ্ছে বাংলাদেশের পুলিশ। নানাভাবে তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে।

আদালতের অভ্যন্তরে তাঁদের অনেককেই পুলিশের সামনেই শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে।

এমনকী, ধৃতদের আইনি পরিষেবা দিতে গেলে আইনজীবীরাও গণরোষের শিকার হচ্ছেন।

আদালতের মধ্যে আইনজীবীদেরও নিরাপত্তা দিচ্ছে না অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রতিহিংসার রাজনীতিতে রীতিমতো বিরক্ত কানাডার এই সংস্থাটি।

সংস্থাটির নজরে এসেছে হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করার পরও বিভিন্ন আছিলায় ধৃতদের আটকে রাখার ঘটনাগুলিও।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনের মাধ্যমে জামিন বাতিল করে চলেছে ড. ইউনূসের সরকার।

এমপিরা আদালত থেকে জামিন পেলেও জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। আদালত থেকে জামিন প্রাপ্তদের জেলের গেটেই ‘গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে’।

নতুন নতুন অপরাধের অভিযোগ তুলে জনপ্রতিনিধিদের গ্রেপ্তারের বিষয়টিও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

শুধু তাই নয়, বিচারের নামে যে তামাশা চলছে সেটাও ধরা পড়েছে কানাডার এই সংস্থাটির প্রতিবেদনে।

ধৃত এমপিদের পক্ষে সওয়াল করার জন্য কোনও আইনজীবী না থাকলেও সরকার পক্ষের একতরফা শুনানিতেই ধৃতদের পাঠানো হচ্ছে পুলিশ অথবা বিচারবিভাগীয় হেফাজতে।

বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাটাই মানবাধিকারের বিপক্ষে চলে গিয়েছে। তাই আইনজীবীরা আদালতের মধ্যেই শাসক গোষ্ঠীর সমর্থকদের হাতে নিগৃহিত হচ্ছেন।

জামিনের জন্য আসামী পক্ষের আইনজীবীদের সওয়ালই করতে দেওয়া হচ্ছে না।

মানবাধিকার সংগঠনগুলি জনপ্রতিনিধিদের মুক্তির দাবি করলেও আদালত বা সরকার কেউই সেই দাবিতে কর্ণপাত করছে না।

আইনের কোনও শাসন নেই বাংলাদেশে। দেশের সংবিধানকে অমান্য করছে সরকার ও বিচার ব্যবস্থা।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. ইউনূসের শাসনামলে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিআর) অনুচ্ছেদ ৯ লঙ্ঘিত হচ্ছে।

নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং আটক থেকে নাগরিকদের রক্ষা করতে আন্তর্জাতিক চুক্তিকে মোটেই গুরুত্ব দিচ্ছে না অন্তর্বর্তী সরকার।

এই চুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক নাগরিকের আছে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার অধিকার।

কাউকে নির্বিচারে গ্রেফতার করা হবে না বা আটক কাউকে তাঁর স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হবে না’।

কানাডার এই গবেষণা সংস্থার মতে, ড. ইউনূসের সরকার সেই চুক্তি না মেনে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগেও অভিযুক্ত।

জিসিডিজির মতে, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা থেকে অবিলম্বে ড. ইউনূস ও তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

আটক সংসদ সদস্যদের অধিকার রক্ষায় কমিশন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির দায়বদ্ধতার কথাও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে মানবাধিকারের জন্য দায়বদ্ধ থাকতে বাধ্য করাটাও জরুরি।

বাংলাদেশে ড. ইউনূসের আমলে শুধু জাতীয় সংসদের সদস্যরাই নন, তাঁর অপছন্দের ব্যবসায়ী থেকে সাংবাদিক কেউই হেনস্থা ও গ্রেপ্তারের হাত থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না।

মিথ্যা খুনের মামলায় বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্পাদক শ্যামল দত্তকে বহুদিন ধরে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে।

বর্তমানে প্রেস ক্লাবের সম্পাদক আয়ুব ভূইঞার বিরুদ্ধেও খুনে মামলা করা হয়েছে। ড. ইউনূসদের অপছন্দের ব্যবসায়ী শুমি কাইজারও ৬ মাস ধরে জেলবন্দি।

নারী হয়েও তিনি মুক্তি পাননি। সাংবাদিক দম্পতি ফরজানা রূপা ও শাকিল আহমেদ ৮ মাস ধরে জেলবন্দি।

প্রবাদপ্রতিম নাট্য ব্যক্তিত্ব তথা জাতীয় সংসদের সদস্য আসাদুজ্জামান নূর ৭ মাস ধরে জেলে বন্দি।

বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শাহরিয়ার কবিরকে ৮ মাস ধরে বিনা কারণে জেলবন্দি করে রাখা হয়েছে।

ড. ইউনূসের শাসনামলের বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিরুদ্ধ মতের নেতা-নেত্রীদের বিনাবিচারে বন্দি রাখার তালিকাও।

জেলের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন। অথচ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলি নীরব। তাই প্রশ্ন উঠছে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা নিয়েও।

#আনোয়ার হুসেইন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *