অনেক প্রত্যাশা নিয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে তৈরি হয় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

মানুষকে তারা স্বপ্ন দেখিয়েছিল, প্রচলিত রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির বিপরীতে দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের।

কিন্তু শুরুতেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সিন্ডিকেটবাজি, চাকরিবিক্রি, বদলিবাজি থেকে শুরু করে সবধরনের অপকর্মের ভাগাভাগি নিয়ে নিজেরাই এখন নিজেদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘর্ষে লিপ্ত।

মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে অনেক আগেই। তাই এখন আর এনসিপি লোক জমাতে পারছে না। জনসমর্থন খুইয়েও তারা ব্যস্ত গোষ্ঠী সঙ্ঘর্ষে।

এনসিপি নেতাদের সমন্বয়ের অভাব এতোটাই প্রকট হয়ে উঠেছে যে দলটি কতোদিন টিকবে তা নিয়েই এখন মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে দলটি আত্মপ্রকাশ করলেও প্রথম থেকেই জামায়াতের ছাত্র শিবিরের প্রভাব নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিলই।

পরবর্তীতে আদর্শগত মতোভেদ আরও প্রকট হয়ে ধরা দেয়। পরিস্থিতি এখন এতোটাই খারাপ হয়েছে যে ২১৮ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে মাত্র হাতে গোনা জনাকয়েককেই সক্রিয় দেখা যাচ্ছে।

নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেন, নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারি, হাসনাত আবদুল্লা ও সারজিস আলম এখনও প্রচারের আলোয় থাকলেও তাদের মধ্যেও বিরোধ চরমে।

সামাজিক মাধ্যমে কে কখন কী বলছেন, জনগণের কাছে তা মাথামুন্ডু দুর্বোধ্য ঠেকছে।

নিজেদের বিরোধের কারণেই তারা এখনও জেলা বা উপজেলা কমিটি গড়ে তুলতে পারেনি।

এনসিপির নেতারা মাঠের রাজনীতিতে না থাকলেও সামাজিক মাধ্যমে বেশ সক্রিয়।

অতিরিক্ত সামাজিক মাধ্যম নির্ভরতায় রাজনৈতিক দিশাহীন দলটির সমর্থন দিন দিন কমছে। সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলেই সেটা সহজেই বোঝা যায়।

অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় এনসিপি দলটি তৈরি হলেও তাদের রাজনৈতিক কোনও দিশা আজও তৈরি হয়নি। নেই কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মসূচিও।

আগামী দিনে তারা কারও সঙ্গে জোট করবে কিনা সেটাও কেউ জানে না। জামায়াত ও বিএনপির সঙ্গ নিয়েও দলের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে।

নাহিদ চাইছেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং ন্যাশনাল সিটিজেনস কমিটি (এনসিসি), এই দুই নামে তৃণমূল স্তরে পৌঁছাতে।

কিন্তু দুটি সংগঠনই নির্বাচন কমিশনে নথিভুক্ত নয়। ফলে নাহিদের এই চিন্তাভাবনা অনেকেরই অপছন্দ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়েও দলের মধ্যে মতবিরোধ তুঙ্গে।

গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি, গণ অধিকার পরিষদ, ছাত্র অধিকার পরিষদ, রাষ্ট্রচিন্তা, ইসলামি ছাত্র শিবির, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র দল, ছাত্র লিগ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, আম জনতার দল, এবি পার্টি-সহ বিভিন্ন দলের ‘খিচুরি’ হচ্ছে এনসিপি।

আর সমস্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিনিধি থাকায় নতুন এই দলটির ভিতর শুরু থেকেই আদর্শগত বিরোধ প্রকট।

তৃণমূল স্তরের সঙ্গে দলের ঢাকার নেতাদের তেমন কোনও যোগাযোগ নেই। বামপন্থী ও মৌলবাদী দুই ধারা ছাড়াও বিভিন্ন পেশাজীবী ও ধর্মীয়গোষ্ঠীর লোকজনও রয়েছেন এই দলে।

কিন্তু সকলের গ্রহণযোগ্য কোনও আদর্শগত ভিত তৈরি হয়নি। ফলে পদে পদে বিরোধ বাড়ছে।

বিরোধ ঢাকা দিতে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের সাফাই, ডান ও বামেদের মধ্যপন্থা ধরে চালিত হচ্ছে এনসিপি।

সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশি চেতনা নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পোস্ট নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে নিয়েও দলটির ফেসবুক পোস্টে বিরোধ ধরা পড়ে।

সেখানেই দেখা যায় এনসিপি সমর্থকরাই লিখছেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা তারা পূরণ করবে। সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে সৌহার্দ্যের পথ ধরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে বাংলাদেশে।

কেউ কেউ আবার ইসলামি মৌলবাদের নিন্দা করেছেন। নানাজনের নানামত থেকে বোঝা যায় দলটির নির্দিষ্ট কোনও লক্ষ্য আজও তৈরি হয়নি।

সমাজকর্মী তথা লেখক ফরহাদ মজহার যথার্থই বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মৌলবাদ নিয়ে এনসিপি বিরোধ যত প্রকট হচ্ছে, ততোই কমছে দলটির গ্রহণযোগ্যতা।

মানুষ আর ভরসা করতে পারছেন না তাদের ওপর। জুলাই-আগস্টের উচ্ছাস আজ অস্তমিত।

নিজেদের এই বিরোধ থেকেই জন্ম নিয়েছে শিক্ষার্থীদের অন্তত ৮০টি সংগঠন। সম্প্রতি সেই বিরোধের হাত ধরেই জুলাই ঐক্য ও জুলাই মঞ্চ নামে দুটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে।

এনসিপি নেতাদের মধ্যেও হতাশার ছাপ প্রকট। সেই হতাশা ঢাকতেই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আরেকটা এক-এগারোর বন্দোবস্ত করার পাঁয়তারা চলছে’।

আসলে তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না কে তাদের আসল শত্রু, কে মিত্র। সঙ্গে রয়েছে ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াই।

এনসিপি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা তাই দুঃখ করে বলেছেন, ‘ক্ষুদ্র স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সমগ্র গণতান্ত্রিক উত্তরণকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

আমরা স্বল্পমেয়াদী হিসাব-নিকাশের জন্য এমন এক জাতির আশাকে আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না, যে জাতি স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে’।

স্বার্থের দ্বন্দ্ব এতোটাই প্রকট যে দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের সঙ্গে এনসিপির কোনও সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম।

অথচ, দুদিন আগেও তারা একসঙ্গে উপদেষ্টামন্ডলীতে ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবেই ছিলেন।

বাংলাদেশে সুপরিচিত অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়াকে গ্রেপ্তারের সময়ও এনসিপির বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে।

আবার মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ থেকে জামায়াতে নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের খালাস নিয়েও বিরোধ তুঙ্গে।

সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান ফেসবুকে জানান, ‘আমি কখনোই এনসিপিকে সমর্থন করব না’।

বহু শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা গত বছর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানালেও তারাই এখন সামাজিক মাধ্যমে এনসিপির সমালোচনা করতে শুরু করেছেন।

জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমাও।

ফেসবুকে তিনি লিখছেন, ‘ছাত্রশিবির বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির পরিবেশকে ‘টক্সিক’ (বিষাক্ত) করে তুলেছে’।

সর্বত্রই প্রকট হচ্ছে মতবিরোধ। বাড়ছে ছাত্রনেতাদের প্রতি মানুষের অনাস্থা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী অভ্যুত্থানের নামে জামায়াতের কাঁধে ভর করে এই ছাত্র নেতারা নব্য ফ্যাসিবাদের আমদানি করেনি তো? প্রশ্ন উঠছে ফেসবুক নির্ভর দলটির ফেসবুকের পাতাতেও।

#আনোয়ার হুসেইন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *