উড়ে এসে জুড়ে বসা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত দশ মাসে ১১টি দেশ সফর করেছেন।

আপাতত: সর্বশেষ যুক্তরাজ্যে ১১তম সফর। যেখানে শুধু গঞ্জনা-বিক্ষোভ-ঘৃণাই জুটেছে তার ও তার করিৎকর্মা প্রেস সেক্রেটারি ডাস্টবিন শফিকসহ সফরসঙ্গীদের কপালে।

আমেরিকা, আজারবাইজান, মিশর, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, চীন, থাইল্যান্ড, কাতার, ভ্যাটিকান সিটি, জাপান এবং সর্বশেষ যুক্তরাজ্য।

যুক্তরাজ্য বাদে বাকী দশটি সফরে প্রায় ২৬০ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে এবং ৭০ দিন সময় অতিবাহিত করেছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- এইসব সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কী অর্জন করেছে? বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার এই সফর নিয়ে সমালোচনার বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

ইউটিউবে নানা ধরনের ভিডিওসহ মন্তব্যে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা ! ষড়যন্ত্রকারিতো ষড়যন্ত্রেই ব্যস্ত।

সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলো, এই ১১টি সফরের একটিও কোন দেশের আমন্ত্রণে সফর করেননি ইউনূস। অবশ্য তারতো লজ্জা বলে কিছু নেই।

সবগুলো সফরই মূলত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মেলনে যোগদানের জন্য হয়েছে। সুযোগ মতো শুধু চীনের প্রেসিডেন্ট ও জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে ছবি তুলেছেন।

ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এইসব সফরে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট কিছুই অর্জনের সুযোগ নেই। এরপরেও এইসব সফরকে বাংলাদেশের মিডিয়া ও সরকারের তল্পিবাহকেরা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে যে, বিরাট অর্জন করে ঘরে ফিরেছে ইউনূস। বাস্তবতা হচ্ছে শূন্য।

অবশ্য ইউনুসের ঝুরিতে শূন্য নয়। নানা ষড়যন্ত্র পাকিয়েছেন তিনি জনগণের ট্যাক্সের পয়সা পানিতে ঢেলে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন ব্যঙ্গাত্বকভাবে লিখেছেন- শান্তির নোবেল পদক সহ অসংখ্য পদকে সিক্ত, সুশাসনের শেষ ভরসাস্থল, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, আলেম উলেমা সমাজের নবী তুল্য মহামানব, নারী সমাজের আশার আলো, মানবতার প্রতীক, সততার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ও মব কালচারের প্রবর্তক মান্যবর ড. মহম্মদ ইউনুস তোমাদের কি ভাবে দেখো !

তিনি নির্বাচন ও গনতন্ত্র নিয়ে তামাশা করতে পারেন নিজে অনির্বাচিত বলে। এখন তারেকের সাথে তার দল এনসিপি ও জামায়াতের মিলন হলো মূল লক্ষ্য।

সিআইএ, এমআইসিক্স ও আইএসআই একত্রিত এই খেলার মাঠে। মূল টার্গেট হলো -ভারত ও চীন। এক্ষেত্রে তারা মিয়ানমারকেও পাত্তা দিচ্ছেনা কারণ মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপ আরকান আর্মিও আপাতত: তাদের পকেটে।

কথিত জুলাই বিপ্লব ঘোষণার নামে সংবিধান বাতিল করা সম্ভব না হলেও সেটিকে ভূলুন্ঠিত করার সব ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।

এরই মধ্যে এখন নৌ ও বিমান বন্দর তুলে দেয়াসহ ‘ মানবিক করিডোর’ দেয়ার মধ্য দিয়ে দেশের চরম সর্বনাশ করার চক্রান্তে রয়েছে।

সেই এক এগারোর সময় দল বানিয়ে অসফল হলেও এবার এনসিপি বানিয়ে কিছুটা সফল।

জামায়াত-হিযবুত-হেফাজত-এনসিপি জোট জিতবে না বিএনপি ছাড়া। সরকারের ভাগাভাগি হবে নাকি এরা সবাই মিলে সরকার গঠন করবে সেটাই দেখার বিষয়।

তবে আওয়ামীলীগের অনুপস্থিতিতে জামায়াত বেশ কূটখেলা খেলতে শুরু করে দিয়েছে। তারা বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে পঁচানোর জন্য যা যা করা দরকার তার সবই করবে ও করছে।

সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান নাসির ব্যঙ্গ করে লিখেছেন- ‘ উনি (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী) সম্ভবত কানাডায় আছেন, কানাডা ভিজিট করছেন।

ব্রিটিশ এক পার্লামেন্টারি এমপি এসেছিলেন, উনি জানালেন যে, উনি (কিয়ার স্টারমার) কানাডায় আছেন।’

‘সম্ভবত’ মার্কা এই তথ্য জানালেন অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। এদিকে, কিছু সূত্র জানাচ্ছে, কিয়ার স্টারমার তাঁর দেশেই আছেন।

তিনি থাকুন বা না-ই থাকুন, এখন তো প্রশ্ন আসে- প্রধান উপদেষ্টার এই ভিজিট আসলেই সরকারি সফর কিনা।

“ ভাবছি, এই দেশ এখন কারা চালাচ্ছেন ? যে বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছেন, সেই বাড়ির গৃহকর্তা ঘরে আছেন কিনা, তা জানেন না।

ওইদেশে কি আমাদের দূতাবাস নেই? সে যা-ই হোক, বৈঠক বা সাক্ষাৎ নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। ভালোয় ভালোয় আমাদের পুরস্কারটা পেলেই হলো। পুরস্কার খুবই দরকার।” – এমন মন্তব্য করেন সাংবাদিক হাসান নাসির। এরকম নানান মন্তব্যে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

তবে রাজনৈতি বিশ্লেষক ও রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা বোঝেন এসন নাগরিকদের মন্তব্য হলো- এইসব সফরে স্বল্পমেয়াদি প্রচারণা ও ব্যক্তিগত ইমেজ নির্মাণ ছাড়া দেশের জন্য বাস্তবিক অর্জন শূন্য।

বরং ইউনূসের এইসব সফর অধিকাংশ ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি করা, তাদের স্বার্থ রক্ষা করা, এবং নিজের ব্যক্তিগত প্রচারণা ও ব্র্যান্ডকে বৈশ্বিকভাবে আরও শক্তিশালী করার জন্য হয়েছে বলেই দৃশ্যমান হয়।

জাপান থেকে ১.০৬ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের বিষয়ে যা ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে তাওতো ইউনুসের ভাষায় ‘ পালিয়ে যাওয়া’ সাবেক প্রধঅনমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে গৃহীত বাংলাদেশের রেল প্রকল্প ও বাজেট সহায়তার ধারাবাহিকতা মাত্র।

নতুন কোনো বড় বিনিয়োগ চুক্তি হয়নি। জাপানের এই অর্থায়নও মূলত পূর্বপরিকল্পিত এবং আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতিফলন মাত্র।

মধ্যপ্রাচ্য সফরগুলোতেও (কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত) বড় বিনিয়োগ আসার আশ্বাস ছাড়া দৃশ্যমান কিছু আসেনি।

সংযুক্ত আরব আমিরাতে শুধু একটি সম্ভাব্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। বাস্তবায়ন অনেক দূরের বিষয়।

গতবছর যুক্তরাষ্ট্রে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে দেখা করলেন, ছবি তুললেন।

কিন্তু বাংলাদেশ কোনো বিনিয়োগ পেয়েছে, বা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে তেমনটা প্রমাণ পাওয়া যায় না।

বরং একে একে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের যাতায়াত-ভ্রমণ নিষিদ্ধসহ অবস্থানরতদেরকে নানা ধরনের সমস্যায় পড়ার কথাই শোনা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সর্বশেষ যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে ‘কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করার কথা দেশীয় মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হয়েছে।

২০২৪ সালে চালু হওয়া কিংস চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ডস মূলত বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের বিশেষ সম্মাননা স্বরূপ সম্মানিত করা হয়।

ড. ইউনূস এই সম্মাননা পেতেই পারেন। কিন্তু কিংস ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে নমিনীদের তালিকায় ড. ইউনূসের নাম না থাকায় সন্দেহ ও সংশয় প্রকাশ পেয়েছে যে, তিনি এই অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হননি।

দেশের মানুষকে বোকা বানানো হয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টার্মার এর সাথে সাক্ষাতের কথাও জানানো হয়েছিল।

কিন্তু পরে ইউনূসের তরফ থেকেই জানানো হয়েছে দেখা হবার সম্ভাবনা শূন্য। তাহলে কেন যুক্তরাজ্য সফরে গেছেন?

তবে রাজনীতি সচেতন নাগরিকরা বলছেন- মূলত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করে নতুন ষড়যন্ত্র করতেই এই সফর ।

বাংলাদেশের আদালতে একজন দন্ডিত ও পলাতক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতে ইউনূসের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ব্যক্তিগত লাভ থাকলেও দেশের কোন লাভ নেই।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে- বাংলাদেশের এই কঠিন সময়ে এই বিদেশ সফরগুলো আদৌ দেশের স্বার্থে হয়েছে কি না ?

যখন বৈদেশিক ঋণ শোধের চাপ বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে রয়েছে- তখন ইউনূসের এই সফরগুলো দেশের অর্থনীতিতে কোনো তাৎপর্যপূর্ণ স্বস্তি আনতে পারেনি।

বরং সফরগুলো নানা লবিং কওে , টাকা পয়সা খরচ কওে, তোষামদি করে ব্যক্তিগত পুরস্কার গ্রহণ, পশ্চিমাদের প্রশংসা কুড়ানো এবং বাংলাদেশকে এক ধরনের ‘ওয়েস্টার্ন প্রক্সি স্টেট’-এ পরিণত করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ড. ইউনূস যেভাবে পশ্চিমাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য নিজেকে ব্যবহার করছেন- তা বাংলাদেশকে আরও পরনির্ভরশীল ও গভীর সংকটের দিকে ফেলে দিচ্ছে।’

এবার একটু দেখি উড়ে এসে জুড়ে বসা ড. ইউনুস বাংলাদেশের জনগণের টাকায় কোথায় কোথায় ব্যক্তিগত সফর করেছেন-

*২৩ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, নিউইয়র্ক।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অংশগ্রহণ।

*১১ থেকে ২২ নভেম্বর ২০২৪, বাকু, আজারবাইজান। ২০২৪ জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে অংশগ্রহণ।

*১৮ থেকে ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, কায়রো, মিশর। ডি-৮ সম্মেলনে অংশগ্রহণ।

*২১ থেকে ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ডাভোস, সুইজারল্যান্ড। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে অংশগ্রহণ।

*১৩ থেকে ১৪ ফেব্রয়ারি ২০২৫, দুবাই, সংযুক্ত আরব আমিরাত। ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে অংশগ্রহণ।

*২৬ থেকে ৩০ মার্চ ২০২৫, হাইনান এবং বেইজিং, চীন। হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ায় অংশগ্রহণ।

এবং বেইজিংয়ে প্রথম দ্বিপাক্ষিক বৈঠক।

*৩ থেকে ৪ এপ্রিল ২০২৫, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড। বিম্সটেক সম্মেলনে অংশগ্রহণ।

*২১ থেকে ২৫ এপ্রিল ২০২৫, দোহা, কাতার। আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ।

*২৬ এপ্রিল ২০২৫, ভ্যাটিকান সিটি। পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ।

*২৮ মে থেকে ১ জুন ২০২৫, টোকিও, জাপান। ৩০তম নিক্কেই ফোরাম ফিউচার অফ এশিয়ায় অংশগ্রহণ।

এবং অনেক অনুনয় করে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক ও ফটোসেশন। আর আপাতত: সর্বশেষ সফর ১০ থেকে ১৩ জুন ২০২৫, লন্ডন, যুক্তরাজ্য। যে সফরটি ষড়যন্ত্র ও অত্যন্ত লজ্জাকর সফর হিসেবেই ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।

অনেকেই বলে থাকেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে পশ্চিমা লবির একজন ‘কেনা গোলাম ’।

তার বিদেশ সফরের ছবি প্রচার করে বাংলাদেশের প্রচার মাধ্যমগুলো বরং বিভ্রান্তিতে ফেলছে জনগণকে।

যা মূলত: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পরিপন্থী।দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারণ এখন যেন ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক এনজিও প্রজেক্টে রূপ নিচ্ছে- যেখানে প্রধান খল নায়ক হলেন ড. ইউনূস।

দেশীয় গণমাধ্যমে তিনি যেন এক বিশ্বনাগরিক, যার এক পায়ে হোয়াইট হাউজ, আর অন্য পায়ে ডাউনিং স্ট্রিট, কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের মাটিতে তার শিকড় ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে।

# নুরুল ইসলাম আনসারী, লেখক ও রাজনৈতিক গবেষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *