বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের কবি- প্রাবন্ধিক- সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর একটি কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ করে। তিনি তার একটি লেখায় স্বশিক্ষিত এবং সুশিক্ষিত মানুষের মধ্যে তফাতের কথা বলেছিলেন।
উচ্চতম ডিগ্রী থাকা সত্ত্বেও মুহাম্মদ ইউনুস যে একজন সুশিক্ষিত মানুষ নন, এমনকি একজন স্বশিক্ষিত মানুষও নন, কার্যত একজন অশিক্ষিত মানুষ—সেটার প্রমাণ আরেকবার দিলেন লন্ডন সফরকালে সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে।
তিনি রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ জনগনের টাকায় বিদেশে ব্যক্তিগত সফর ও আমোদ- প্রমোদ করছেন।
লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে তিনি রাস্তার ক্যানভাসারদের মত হাত পা নেড়ে অনেক কথা বলেছেন। বিদেশে গেলে তিনি বিদেশী গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে ভীষণ পুলক অনুভব করেন।
কারণ দেশের সংবাদমাধ্যমতো সবাই তার বশংবদ। তারাতো তার কথা প্রচার করবেই।
তাই তিনি বিদেশী সংবাদমাধ্যমকেই বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কারণ তিনিতো সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন না।
তার ক্যানভাসার সদৃশ সাক্ষাৎকারেই তিনি গণতন্ত্র ও দেশের নাগরিকদের অপছন্দের কথা বলে ফেলেছেন হাত- পা নেড়েচেড়ে।
সুতরাং এই উচ্চসুদখোর নোবেল লরিয়েটের কাছ থেকে গণতন্ত্র- দেশপ্রেম আশা করা চরম বোকামি।
লন্ডনে অবস্থানকালে ড. ইউনুসকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন—তিনি সবসময় যেখানে বলেন সবাইকে নিয়েই তিনি এগুতে চান, তাহলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী ( বঙ্গবন্ধু যাদুধর) কেন, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল?
উত্তরে মুহাম্মদ ইউনুস বললেন, বাংলাদেশের পুলিশ অপরাধ দমন করার জন্যে রাস্তায় দাঁড়াতে ভয় পায়।
এই পুলিশই হাসিনার নির্দেশে কারো ভাইকে মেরেছে, কারো বোনকে মেরেছে; এখন তারা জনগণের মুখোমুখি হতে ভয় পায়।
আমি ভেবে অবাক হই, একটা মানুষ কতটা ভণ্ড হতে পারে! ছয়দিন ধরে ঢাকা শহরের বুকের এই ঐতিহাসিক বাড়িটা ভাঙা হয়েছে, এবং সেটা করা হয়েছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বুলডোজার ব্যবহার করে; কিন্তু তিনি কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি।
এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তাকে বলেছে, তারা ঘটনাস্থলে যেতে ভয় পাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে ‘ নায়ক’ নামে একটি হিন্দি ছবি দেখেছিলাম। ছবিটিতে — অনিল কাপুর নায়ক, অমরেশ পুরী ভিলেন।
অমরেশ পুরী একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী; রাস্তায় অবৈধ ব্যারিকেড চলছে তুচ্ছ একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
যারা এই অবরোধ করছে এবং রাস্তায় ভাঙচুর চালাচ্ছে, তারা তার দলের অনুসারী; পুলিশ এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানান।
বত্রিশ নম্বর বাড়িটা ভাঙার আমার এই দৃশ্যটার কথা মনে পড়েছে বারবার।
গোটা ব্যাপারটা তাঁর ইচ্ছেতেই ঘটেছে; তিনি ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্যে এই মব লেলিয়ে দিয়ে এই কাজটা করেছেন।
তিনি এবং তাঁর অনুসারী মববাহিনী ছাড়া বাংলাদেশের সবাই এই ব্যাপারটা জানে। হাত পা নাড়িয়ে কতগুলো মিথ্যা বললেই মিথ্যা সত্য হয়ে যায় না।
এই ধরণের সাক্ষাৎকারগুলোর একটা সমস্যা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে উত্তরের বিপরীতে সম্পূরক প্রশ্ন করা যায় না।
তার ওই প্রশ্নের বিপরীতে যদি ওই সাংবাদিক তাকে পাল্টা প্রশ্ন করত—পুলিশ না হয় ভয় পাচ্ছিল, কিন্তু ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর একটা দল হাজির হয়েছিল, তাদেরকে ফিরে যেতে হয়েছে কেন?
তারা কেন সেই বাড়িটাকে রক্ষা করতে পারল না? কার নির্দেশে তারা ফিরে গেছে, কিংবা ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে?
ভাগ্যিস! এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতে হয়নি! হলে তার পরনের কাপড় খুলে যেত!
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর সেই উলঙ্গ রাজার মত তাকে উলঙ্গই দেখাত। তিনি যে উলঙ্গ, সেটা তিনি নিজে দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু বাকি সবাই দেখতে পাচ্ছেন।
আরেক জন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন—সংস্কার প্রশ্নে তিনি জনগণের কাছে যাচ্ছেন না কেন? জনগণই তো এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক।
এর উত্তরে এমন একটা কথা বলেছেন, যেটা পৃথিবীর অন্য কোনও এক দিনের রাজাও বলেছিলেন কিনা আমার জানা নেই।
ইউনুস বলছেন, জনগণের উপর তার বিশ্বাস নেই, কারণ জনগণ টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায়। যারা বেশি টাকা দেয়, তারা সেদলে ভিড়ে যায়।
যারা বেশি কথা বলে, তারা নিজের অজান্তেই অনেক সময় যে কথাটা সর্বসমক্ষে বলা উচিত নয়, সেটাও বলে ফেলে।
মোল্লা ইউনুস সেটাই করলেন; তিনি প্রকাশ করে বসলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি তাঁর বিশেষ কোন আস্থা নেই।
এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের এই ফ্যাসিবাদী দিকটা আমাদের সামনে উন্মোচিত হলেও, এই বক্তব্যের আরেকটি অত্যন্ত ভয়াবহ দিক আছে।
জনগণকে পয়সা দিয়ে কেনা যায়—এই কথাটা বলে বাংলাদেশের সমস্ত জনগণকে এককথায় ভীষণ রকম অপমান করলেন।
একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই—নির্বাচনে টাকার ব্যবহার হয়।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই টাকার বিনিময়ে তাদের অধিকার বিক্রি করে দেয়।
কিন্তু যে মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী গত বছরের জুলাই-আগস্ট মাঠে নেমে এসেছিল বলে তিনি আজকে রাজা সেজে বসে আছেন, তাদেরকে কি টাকা দিয়ে কেনা যায়?
যে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে তিনি এবং আদিলুর রহমান গং হাসিনার বিরুদ্ধে মেটিকুলাস প্ল্যান করে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছিলেন, সেই সময় যে সমস্ত সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল, তারা কি তাহলে অর্থের বিনিময়ে রাস্তায় নেমেছিল?
এইরকম বিভ্রান্তিকর জঘন্য মন্তব্য করে তিনি যারা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাদেরকেও প্রকারান্তরে অপমান করলেন।
ইউটিউবার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান তাঁর জায়েদ টেক-এ ইউনূসের এই আচরণকে গণতন্ত্রের প্রতি blasphemy বলে মন্তব্য করেছেন; আমি তাঁর ওই বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত।
জাতি হিসাবে আমাদের দুর্ভাগ্য—ফ্যাসিস্ট বলে গালাগাল দিয়ে শেখ হাসিনাকে সরিয়ে আমরা যাকে ক্ষমতায় বসিয়েছি, সে হাসিনার চাইতেও বড় ফ্যাসিস্ট।
সুখের কথা, যত দিন যাচ্ছে, ততই তার মুখোশের আড়ালের চেহারাটা বেরিয়ে আসছে।
এই জাহেদুর রহমানরাও একসময় তাঁর পেছনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল; এখন তারাও বুঝতে শুরু করছে—তাঁকে যা মনে করা হয়েছিল, তিনি আসলেই তা নন।
বর্তমান নির্লজ্জ ইউনুস সরকার নানাধরনের দূর্নীতি, অযোগ্যদের তোষামদি করা, দক্ষ- যোগ্য কর্মকর্তাদেরকে অপসারণ, চাকরিচ্যুত, মামলা-জেলহাজতে ঢুকিয়ে দিতে বেশ পারঙ্গমতা দেখাচ্ছে।
বর্তমান অথর্ব সরকারের অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে হারুন আল রশিদ নামে বাংলাদেশী কূটনীতিক বর্তমান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করেছেন।
যিনি মরক্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
কিন্তু তিনি আর থাকতে পাররেন না জংলী ইউনুস সরকারের সাথে। সবকারের পক্ষত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
তবে পদত্যাগ করেই ক্ষ্যান্ত হননি এই প্রতিবাদী সাহসী কূটনীতিক। নানা বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন তিনি।
সম্প্রতি তিনি তার একটি লেখায় যেসব মন্তব্য করেছেন তাতেই বোঝা যাচ্ছে সরকারের অথর্বতা, জঙ্গীত্ববাদ ও পশ্চিমাদের কাছে আত্মসমর্পনের বিষযটি।
এতে তিনি বলেছেন– আমাকে এক ভারতীয় সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছিলেন তৌহিদ হোসেনকে বসাই দিছে কি না।
আমি খোঁজ রাখি না। আর ফরেন মিনিস্ট্রির পোলাপাইনতো এখন আমার ধারে কাছে ঘেষবে না।
তৌহিদ হোসেন, সালেহউদ্দিন, শাখাওয়াত এই তিন জন ছাড়া এখন ইউনুসের সাথে যারা আছে এরা সবাই ইন্টারন্যাশনাল টাউট বাটপার।
এই কূটনীতিক ব্যঙ্গাত্বকভাবে লিখেছেন– দেখেন না, বাটপারগুলি লন্ডনে গিয়ে কী করল? আহারে।
বিমানের প্রথম শ্রেণি থেকে গিয়ে এই ইউনুস সুয়ারেজের নর্দমায় পড়ল। অবশ্য সেই খালেও এই বাটপার লামিয়াকে নিয়ে আনন্দেই আছে।
কিন্তু বাংলাদেশতে গেলো। রজার খলিল আর ডাস্টবিন যদি ইউনুসকে বলত, সার, এত নাটক না করি, সবাইকে বলি আমরা তারেক রহমানের সাথে বৈঠক করতে যাচ্ছি, তা হলে ব্যাপারটা থেকে কিছুটা হলেও মুখ রক্ষা হত।
যেহেতু বাটপার জঙ্গি ইত্যাদি প্রজাতি সোজা জিনিস চিন্তা করতে পারে না, তাই তারা সব পেঁচিয়ে ফেলেছে।
আর ইউনুসকে বিবিসির সহ বহু সাংবাদিক বেইজ্জত করেছে। কিন্তু ইউনুসের যেহেতু লজ্জা নাই সেহেতু ইউনুস গলায় দড়ি দেয়নি।
পৃথিবীতে এটা একটা নতুন ইতিহাস হল: কী ভাবে জঙ্গিরা একটা শরিয়া রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য একটা দেশকে একটা পশ্চিমা চাকরের রসনা আর লিঙ্গের আনন্দের জন্য বিক্রি করে দিল।
আর ওই চাকর দেশটাকে বিক্রি করে দিল পশ্চিমাদের কাছে।
বাংলাদেশের মানুষ এতটাই জঙ্গি প্রেমে শেষ হয়ে গেছে যে ক্ষুধা, দারিদ্র, অনিশ্চয়তা সব কিছু তার দরজায় চলে এলেও শুধু তার ভারত ও হিন্দু ঘৃণার চাহিদা পূরণ হচ্ছে দেখে তারা ইউনুসকে আঁকড়ে ধরে আছে।
ইউনুস আর তার বাটপার বাহিনী আর জঙ্গিরা। সবাইকে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছে সামরিক বাহিনীগুলি।
আমি সামরিক বাহিনী সম্পর্কে কিছু বলব না। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই ইতিহাস প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
তাদের যেইটা প্রধান উদ্বেগের বিষয়: জাতিসংঘে চাকরি করা। এই বিষয়টা আমার জীবনে কখনওই ভাল লাগে নাই। এই ধরনের চাকরি ভিক্ষাবৃত্তি।
আমরা তো আসলে দেশই গড়তে পারিনি। তাই আমাদের সামরিক বাহিনীগুলির মূল কনসার্ন হয়ে গেছে জাতিসংঘের চাকরি।
আমি দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীগুলির বিবেকবান সদস্যদের দুই মিনিট চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখতে বলব: কোনও দেশের সামরিক বাহিনীগুলির কাছে জাতিসংঘে চাকরি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে কি না।
মজার বিষয় হইল ইউনুস, ইউনুসের অধীন জঙ্গিরা, এবং জুলাইআগস্ট জঙ্গি উত্থানের সকল সহযোগী পারমুটেশন কম্বিনেশন করে যে ভাবেই ক্ষমতায় থাকুক, বাংলাদেশে তত দিন কোনও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না, বাংলাদেশ আরও দরিদ্র হবে, ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনাতে এর মধ্যে ইউনুস শেষ করে দিয়েছে, আর বাকি কিছু নাই।
এবং সামরিক বাহিনীগুলির জাতিসংঘের চাকরিও চলে যাবে।
আরও খারাপ কথা: এই ভাবে চললে বাংলাদেশের সকল সরকারি বেসরকারি কর্মচারির এক সময় বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। টাকার অভাবে।
এ ভাবে কয়েক বছর গেলে বাংলাদেশের মানুষ পায়ে পড়ে মাফ চেয়ে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আনবে। আর জুলাই-আগস্টের সকল সন্ত্রাসীকে কচুকাটা করবে।
# নুরুল ইসলাম আনসারী, লেখক, প্রাবন্ধিক।