যে দিনটিতে এ মনোবেদনা প্রকাশ করছি সেদিনটি একটি অনন্য দিন। অনন্য বলছি এ কারণে যে- আজ এই বঙ্গে জন্ম নিয়েছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। আপনাদেরকে নিশ্চয়ই আর কে এই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার তা নতুন করে পরিচয় দিতে হবেনা। যে প্রীতিলতা ব্রিটিশ শাসন শোষন অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য অপরিসীম সাহসের সাথে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই ত্রিশের দশকে সেই বাংলাতে আজ নারীর প্রতি চরম অপমান সইতে হচ্ছে বাংলার মানুষকে !
বাংলাদেশের রাজধানীতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক নারী প্রতিকৃতিতে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করলো ইসলাম নামধারী কিছু তষ্কর। কিন্তু এ নিয়ে বাংলাদেশের নারীবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কোন উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আছে বলে মনে হচ্ছেনা। কি বিচিত্র এই বাঙালী সমাজ ! হয়তো কয়েকদিন পরে এসব সংগঠনের ঘুম ভাঙতে পারে।
কারা করলো এ অপকর্মটি, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কওমী মাদ্রাসা থেকে ইসলাম ধর্মীয় (!) শিক্ষায় শিক্ষিত আলেম সমাজ ও ইসলাম রক্ষাকারী তৌহিদী জনতাই যে সে কাজটি বীরদর্পে করেছেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আশ্চর্যের বিষয় হলো বাংলাদেশে বর্তমানে যে অন্তবর্তীকালীন সরকার রয়েছে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সেখানেও কিন্তু বেশ কয়েকজন নারী উপদেষ্টা রয়েছেন। এসব উপদেষ্টাগণ বড় বড় মন্ত্রনালয় সামলান। তাঁরা শুধু উপদেষ্টাই নন- প্রত্যেকেই আবার কথিত মানবাধিকার সংগঠক-নেত্রীও বটে। কিন্তু তাঁদের মুখ থেকে একটি কথাও এখন পর্যন্ত বের হয়নি। কারণ তাদের কাছে পদ পদবীই মুখ্য। নারীর অধিকার বা মর্যাদা কোন বিষয়ই নয়-অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে।
আচ্ছা ভাবুনতো গত ৩ মে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে ওই চরম সাম্প্রদায়িক সংগঠনটির হাতে এসব নারী উপদেষ্টাদের কেউ যদি এভাবে শারিরীক ও মানসিকভাবে চরম অপদস্ত হতেন তারা তখনও কি নিশ্চুপ থাকতেন ? নারী অধিকার সংস্কার নিয়ে বর্তমান ইউনূস সরকারের গঠিত নারী কমিশন যে রিপোর্ট জমা দিয়েছে তার প্রবল বিরোধীতা করেছে বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো।
একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী মূল রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যসব দলই নারী স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী। এরা কখনোই চায়নি বা চায়না যে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করুক। এরা নারীকে শুধু অবগুন্ঠনেই রাখতে চায়না- একবারে কালো হিজাবে মুড়ে ঘরেই রাখতে বদ্ধপরিকর।
এ দেশে নারী জাগরণের অগ্রদূত কবি বেগম রোকেয়ার ‘ অবরোধবাসিনী’র কথাই মনে পড়ে যায় এক্ষেত্রে। ১৯৩১ সালে প্রকাশিত এই বইটিতি তিনি গল্পাকারে পর্দা প্রথার মাধ্যমে নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখার যে অপচেষ্টা-ষড়যন্ত্র ছিল তার বিরুদ্ধে এই মহিয়সী নারী যে আন্দোলন-সংগ্রামের কথা বলেছেন তা বর্তমান বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত। শুধু অনুপস্থিত বললে ভুল বলা হবে । বরং নারীকে আরো কি করে অবরুদ্ধ করে রাখা যায় তার সমস্ত আয়োজনই চলছে।
আওয়ামীলীগ বর্তমানে বাংলাদেশে একপ্রকার নিষিদ্ধ, যদিও অফিসিয়ালি বা আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কোন ঘোষণা আসেনি। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারি এই দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর দলের উচ্চপর্যায়ের নেতাদের অনেকেই পলাতক নাহয় কারান্তরালে। কিন্তু আওয়ামীলীগের বাইরে কি আর কোন রাজনৈতিক দল নেই – সে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই ওঠে।
অসংখ্য নারী সংগঠন রয়েছে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে। নারীদের অধিকার-স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করে এমন অসংখ্য বেসরকারি সাহায্য সংস্থা ( এনজিও) রয়েছে। তারাও একদম নিশ্চুপ। কুলুপ এঁটে বসে আছেন এরা। বাংলাদেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মেয়েরা লেখাপড়া করছে। এসব তরুণীরা প্রতিবাদী জানতাম। কিন্তু তারাও একেবারে নিশ্চুপ। মনে হচ্ছে- কোন কিছু বলা যাবেনা, দেখা যাবেনা, প্রতিবাদ করা যাবেনা গোছের এক অন্ধকার সমাজে বসবাস করছি আমরা বাংলাদেশের নাগরিকরা।
এধরনের যে কোন সামাজিক অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সাধারণত প্রকাশ্যে রাজপথে প্রতিবাদ, সমাবেশ বা মিছিল করতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোরগোল পড়ে যেতো। কিন্তু এবার সেটাও খুব একটা চোখে পড়ছেনা। তবে একেবারেই যে প্রতিবাদ হচ্ছেনা তা বলা যাবেনা। তবে যা হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একবারেই নগণ্য। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের প্রতিবাদী নারীরা-ছাত্রীরা ডামি রাইফেল কাঁধে নিয়ে সেই পকিস্তান আমলেই প্রকাশ্য রাজপথে মিছিল করেছেন। তারাইতো আমাদের পূর্বসুরী। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি অসীম সাহসে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশের স্বাধীনতায় অসামান্য বীরত্বপূর্ন অবদান রেখেছেন। এজন্য বীর প্রতীক উপাধিও পেয়েছেন। এই বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিলেন বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, মাতঙ্গীনী হাজরা, সংগ্রামী ইলা বসু যিনি নাচোল বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বীরত্বের সাথে। আর কত নারী বিপ্লবী বা নেত্রীর কথা বলবো ?
কিন্তু সেসব উদাহরণ সব কি রসাতলে গেলো ?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে সাংবাদিক- সামাজিক সংগঠক শাহানা হুদা লিখেছেন- ‘এই অপমানটা ভুলতে পারছি না। দেশে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা কেন বেড়েছে, তা স্পষ্ট। নারীর আব্রু রক্ষার নামে নগ্ন করার এই প্রক্রিয়াকে, যারা ফ্যাসিস্ট বিরোধিতা মনে করে মনে মনে সুখ লাভ করছেন ও ন্যূনতম প্রতিবাদটুকু করছেন না, তাদের প্রতি ঘৃণা। তিনি লেখেন- বিশেষ করে নারী অধিকার কর্মী, এনজিও, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, মানবাধিকার কর্মী যারা নারী ইস্যু বিক্রি করে কামাই করেন, তারা কেন চুপ? কী স্বার্থে চোখ বন্ধ করে আছেন?’
ফেইসবুকের কল্যাণে অন্তত কিছু ছবি, ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশের মিডিয়া ( সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল) সব যেন চোখ বন্ধ করে বসে আছে। কোথাও কোন লেখা নেই, প্রতিবাদ নেই। ফেইসবুকে কেউ কেউ অবশ্য প্রতিবাদ করছেন, তবে তা সংখ্যায় খুবই কম। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও নিশ্চুপ ! কি এক অজানা আশংকা যেন গ্রাস করেছে গোটা জাতিকে।
কিন্তু এ থেকে মুক্তি পেতেই হবে। এদেশের প্রতিবাদী নারী সমাজই শুধু নয় তাদেও পাশাপাশি পুরুষরাও প্রতিবাদী হয়ে মাঠে নামবেন এসব ধর্মান্ধ অন্ধকার গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সে অপেক্ষায় রইলাম। এ বিষয়ে আরো লেখার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এদেশের নারী সমাজ প্রীতিলতার আদর্শে আবারো গর্জে উঠবে-সেদিন আর বেশি দূরে নেই।
#ইশরাত জাহান ঢাকায় অবস্থান করা একজন লেখিকা।