-ঠাকুর ঘরে কে?
-আমি কলা খাইনি!

গল্পটি সকলেরই জানা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সাম্প্রতিক বক্তব্য সেই কথাটিই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

চীনের কুনমিং-এ ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পর তিনি বলেছেনে, ‘আমরা কোনো জোট গঠন করছি না।’

অথচ, বাংলাদেশে আওয়ামি লিগ সরকারের পতনের পর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দুই শক্তি চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সখ্যতা অনেকটাই বেড়েছে।

কমেছে তাঁদের ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কের বন্ধন। অথচ, এই পাকিস্তানই একাত্তরে চীন ও আমেরিকার সরাসরি সাহায্য নিয়ে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল।

ভারত সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ানোতেই জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রটি। সেই ইতিহাস ভুলে বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভারত বিরোধিতায় মগ্ন, এমনটাই অভিযোগ আওয়ামি লিগের।

সম্প্রতি চীনের কুনমিং-এ নবম ‘নবম চীন-দক্ষিণ এশিয়া প্রদর্শনী এবং ষষ্ঠ চীন-দক্ষিণ এশিয়া সহযোগিতা বৈঠক’-এ অংশ নেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব মো. রুহুল আলম সিদ্দিকি, চীনের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সান ওয়েডং ও পাকিস্তানের অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব ইমরান আহমেদ সিদ্দিকি।

সেই বৈঠক অবশ্য তেমন একটা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে পাকিস্তানের মতোই চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলির সখ্যতা অনেকটা বেড়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা লাভের পরও চীন কিন্তু বহুকাল দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা দখল করে চীন সফরে গেলে তবে তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকার করে।

সেই কারণেই এবছর পালিত হচ্ছে বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর।

অন্তর্বর্তী সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটাকেই ভালোতে চাইছে। তারই অঙ্গ হিসাবে জামায়াত নয়া কৌশলে একাত্তরের ভূমিকার জন্য এখন ক্ষমা চাইছে।

জামায়াতে ইসলামির আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘শুধু ১৯৭১ সাল নয়, ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যদি আমাদের দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, আমি তাঁদের সকলের কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা প্রার্থনা করছি’।

এটা যে কৌশল মাত্র সেটা ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফের সঙ্গে তাঁর ঘন ঘন বৈঠকেই প্রমাণিত।

একাত্তরের ইতিহাস ভুলে পাকিস্তানের সঙ্গে ভাব করতে মরিয়া বিএনপি ও এনসিপিও। তাই তাঁদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কে বেশি ইসলামাবাদকে খুশি করতে পারে!

অর্থনৈতিক ভাবে দেউলিয়া পাকিস্তানের আসল চালিকাশক্তি চীন। তাই ঘন ঘন চীন সফর করছেন বিএনপির নেতারা।

সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগিরের নেতৃত্বে দশ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের চীন সফর করেছে।

তার আগে, ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খানের নেতৃত্বে বিএনপি ও মিত্র রাজনৈতিক দলের একটি প্রতিনিধি দল সফর করে চীন।

গত বছর নভেম্বরে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান খান রিপনের নেতৃত্বেও চীন সফরে যায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল।

ঢাকাতেও চীনা দূতাবাসে বিএনপির যাতায়াত বেড়ে গিয়েছে। চীন থেকে ফিরে বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সরাসরি বলেছেন, ‘সামনে নির্বাচনে আমরা যদি সরকার গঠন করি তাঁদের যেন প্রবেলেম না হয়, ধারাবাহিকতা যেন থাকে, এগুলো নিয়ে আলাপ হয়েছে’।

আর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির বলেছেন, ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সঙ্গে অত্যন্ত ফলপ্রসূ ও সফল বৈঠক হয়েছে। পার্টি টু পার্টি সম্পর্ক আরও নিবিড় ও শক্তিশালী হয়েছে’।

বাংলাদেশে চীনের প্রায় ৪২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে। তাই নিজেদের দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত করতেই চীন এখন বাংলাদেশ প্রেমে মজেছে।

শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতকেও তাঁরা পাশে রাখছে। জামায়াতের ইসলামির আমির শফিকুর রহমান তাই বলেছেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমাদের পাওয়ার ও জানার অনেক কিছু আছে।

চায়নিজ শিক্ষার একটা উচ্চতর একাডেমি এখানে গড়ে তুলতে হবে, যাতে আমাদের পরবর্তী জেনারেশন চীনের সঙ্গে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে।’

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে আসা এবং অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির নেতারাও সমানে চীন ও পাকিস্তান ভজনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে নিয়মিত বৈঠক চলছে পাকিস্তান ও চীনের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। সেই বৈঠক থেকেই উগ্র ভারত বিরোধিতার উসকানি মিলছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে।

অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভুলিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলিকে ভারত বিরোধিতার সুর চরাতে উৎসাহিত করছে পাকিস্তান ও তাদের দোসররা।

জামায়াত, এনসিপির মতোই তাই বিএনপির গলাতেও বাড়ছে ভারত বিরোধিতার ঝাঁঝ।

আমেরিকা নিয়ে অবশ্য তেমন মাথাব্যাথা নেই বর্তমান বাংলাদেশের। কারণ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর ঘণীষ্টেরা অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রেরও নাগরিক। দুই কূল রক্ষা করেই চলছেন তাঁরা।

ফলে চীনের উইঘুর মুসলিমদের ওপর অমানবিক ও নৃশংস অত্যাচারের মতোই মুসলিম দেশগুলিতে আমেরিকার দাদাগিরি হজম করতে তাঁদের কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।

এমনকী, তাঁদের এই দুই বন্ধু দেশের সুরে সুর মেলাতে গিয়ে দেশবাসীকে বিপদের দিকে ঠেলে দিতেও হাত কাঁপছে না।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের ভুল বিদেশ নীতিই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বিপথে চালিত করছে। তাঁদের আশঙ্কা, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতোই অবস্থা হতে চলেছে দেশটির।

তবু ক্ষমতার লোভে দেশবাসীকে বিপদে ঠেলে দিচ্ছেন রাজনীতির কারবারিরা। চাঁদাবাজি আর সিন্ডিকেটবাজির পাশাপাশি বিভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতিও সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ।

জনগণ দুর্ভোগে থাকলেও নেতা-উপদেষ্টারা অবশ্য খাসা আছেন, ইউনূস সাহেবের শাসনামলে। নেই শুধু আইনের শাসন!

#আনোয়ার হুসেইন 

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *