বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে ১০ মে। নতুন কিছু কি ঘটেছে ? ২০২৪ এর ৫ আগস্ট আওয়ামীলীগ সরকারকে উৎখাত ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার দিন থেকেই তো আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলো অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সবই হয়েছে ‘মেটিকুলাস ডিজাইন বা প্ল্যান ’ এর অংশ হিসেবে। তাই গত ১০ মে গভীর রাতে বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের সরকারি বাসভবন যমুনা’র সামনে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তার অন্য পারিষদবর্গ নিয়ে যখন আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি জানালেন তাতে অন্য কেউ বিষ্মিত হলেও আমি বা আমার মত একটু রাজনীতি সচেতন নাগরিক বিষ্মিত হইনি।
কারণ গত প্রায় সাড়ে নয় মাস কি আওয়ামীলীগ বা তার অন্য সহযোগী সংগঠনগুলো স্বাভাবিক রাজনৈতিক-সামাজিক কর্মকাণ্ড করতে পেরেছে ? না পারেনি। তাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। অনেকে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। হাজার হাজার নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়ে জেলে কাটাচ্ছেন। অথচ এই আওয়ামীলীগের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস এদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্ম হয়েছিল।
পৃথিবীর মানচিত্রে লাল-সবুজ পতাকার একটি গর্বিত দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। আর যে নেতার নেতৃত্বে , যার নামে তখন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তিনি আর কেউ নন- বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কিন্তু সেই ১৯৭১ থেকে ২০২৫ এর ১০ মে আমাদেরকে শুনতে হলো- গোলাম আযমের বাংলায় আওয়ামীলীগের ঠাঁই নাই ! অবাক হইনি এসব শুনে, কষ্ট পেয়েছি, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ হয়েছে-হচ্ছে। যে গোলাম আযমের দল ও তার নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুধু চরম বিরোধিতাই করেনি। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে মুক্তিকামী মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করেছে। অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। সেই কুলাঙ্গারের বাচ্চা খুনী-রাষ্ট্রদ্রোহী গোলাম আযমের পক্ষে শাহবাগ চত্বর থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা এমন শ্লোগান দেয়ার আস্ফালন ও ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। এটিই নির্মম বাস্তবতা এখন বর্তমান বাংলাদেশে।
এর আগে গত ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর আওয়ামীলীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল প্রজ্ঞাপন জারী করে। তবে রোববার যেহেতু বাংলাদেশে সরকারি ছুটি ( বুদ্ধ পূর্ণিমার ছুটি) ছিল তাই হয়তো আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারেনি। তবে সেটিও এখন বেশ দ্রুত করে ফেলবে বলেই মনে হচ্ছে।
সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর আদেশ পাওয়া মাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন আওয়ামীলীগের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবে এমনটাই জানা গেছে। ১১ মে রোববার নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সরকার থেকে যে আদেশ জারি হবে, সে আদেশের শর্তানুযায়ী প্রচলিত আইন অনুসরণ করে ইসির যা করণীয় তাই করবে। ওইটা আমাদের হাতে এলে, এর উপর ভিত্তি করে কমিশনের যা করণীয় করা হবে।” নির্বাচনী আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে দলটি নিবন্ধন বাতিল হয়ে যায়।
যেহেতু বাংলাদেশে এখন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন সরকার নেই সুতরাং আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করাসহ বাংলাদেশের জনগনের স্বার্থবিরোধী যেকোন সিদ্ধান্ত ড. ইউনুসের সরকার নিতে পারে। কারন তিনি একটি অনির্বাচিত- অসাংবিধানিক-অগণতান্ত্রিক সরকারের প্রধান। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার সমস্ত প্ল্যানই করেছিলেন এই ড. ইউনুস।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জামাতে ইসলামী, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরীর এর মত চরম সাম্প্রদায়িক ইসলামী দল ও আরো কয়েকটি দলকে কথিত ছাত্র-গন আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। আমেরিকার অর্থ ও ইন্ধনে সংগঠিত এই ‘ মেটিকুলাস প্ল্যান’ এর মূল কূশীলব কিন্তু শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনুস। তবে এজন্য ‘ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর নামে ইসলামী কিছু ছাত্র সংগঠনকে কাজে লাগানো হয়েছিল। আর এসবের পেছনে আরো সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তুরস্কের এরদোগান সরকারের এজেন্টরা।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে ও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বর্তমান স্বৈরতন্ত্রী অবৈধ ইউনুস সরকার কর্তৃক আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে নানা প্রতিবাদ উঠেছে। বাংলাদেশের ভেতওে যেহেতু প্রকাশ্যে আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে নামতে পারছেন না প্রতিবাদ করতে তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন সামাজিক গ্রুপেই এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের উপায় বের করার জন্য নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে।
গত ১০ মে রাতেই আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সাথে গ্রুপ মিটিং করেছেন ভার্চুয়ালি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশে এখনো অবস্থানকারি সাবেক একাধিক ছাত্রলীগ নেতা জানিয়েছেন নেত্রী ( শেখ হাসিনা) এখনই রাজপথে নেমে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে বারণ করেছেন। কারন তিনি শক্তি ক্ষয় হতে দিতে চান না। ধৈর্য্য ধারণ করে নিজেদেরকে সুসংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, পাশাপাশি আওয়ামী পরিবারের ( আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা এভাবেই নিজেদের পরিচয় দেন) যেসব নেতাকর্মীর পরিবার বিপদে রয়েছে তাদেরকে সাহায্য করার পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত: আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। যার বয়স এখন পঁচাত্তর বছর। সেই দলটি এদেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের সাথে মিশে আছে। এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে, মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এ দলটির ত্যাগ তিতিক্ষা অপরিসীম। এই দলটি অনেক সময় অনেক ভুল করেছে, কিন্তু মানুষ থেকে দূরে সরে যায়নি।ফলে এখনো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে অসংখ্য নেতাকর্মী-সমর্থক মাটি কামড়ে মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছেন নীরবে। পাকিস্তান আমলেও আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যিনি তখন দলটির সভাপতি তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে আওয়ামীলীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা হযেছে। তখন দলটির মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে টুকরো করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে খুব বেশি সুবিধে হয়নি। আবার আওয়ামীলীগ উঠে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশের জনগণকে সাথে নিয়ে।
২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভেনিউতে আওয়ামীলীগের জনসভায় তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় উপর্যুপরি গ্রেনেড হামলা ও বৃষ্টির মতো গুলি করে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। শেখ হাসিনা সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও মহিলা আওয়ামীলীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ কমপক্ষে ২৪ জনকে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয়। আহত হয়েছিলেন অন্ততপক্ষে ৩০০ শতাধিক মানুষ। শুধু তাই নয় শেখ হাসিনাকে এই বাংলাদেশে অন্তত:পক্ষে ২০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। গত ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টও তাঁকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছিল সেনাবাহিনীর ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াত-হিজবুত তাহরীর এর একটি গ্রুপ। তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কড়া নজরদারির কারণে এ যাত্রাও রক্ষা পান তিনি। তবে সেনা-নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানদের সহায়তায় তাঁকে সসম্মানে আকাশপথে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হলে তিনি ও তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা রক্ষা পান।
যেহেতু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পর দল যখন নানাভাবে বিধ্বস্ত তখন ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হয়। সেই থেকে তিনি দলটির সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। আর তাঁর ডাকে এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি এদেশের আপামর জনগণের অপরিসীম ভালোবাসার কারণেই আওয়ামীলীগ টিকে আছে এখনো। শুধু তাই নয় যারা ভেবিছিলো ’৭৫ এর পর আর কোনদিন আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসতে পারবেনা সেই দলটিই কিন্তু আন্দোলন সংগ্রাম করে, অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে ১৯৯৬ তে ক্ষমতায় আসে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে। এরপর আবার ২০০৯ সাল থেকে টানা চারবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু ২০২৪ এর দেশি বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও ইসলামী অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাকে ও আওয়ামীলীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে একটি বড় বিপর্যয় নেমে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ তাঁর নির্দেশ পেলে এখনো দলের নেতাকর্মীরা ও সমর্থকরা আবারো একাত্তরের মত মাঠে নামতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেই জানা গেছে। আর ইতিমধ্যেই ড.ইউনুস সরকারের গত ৯ মাসের শাসন-শোষণ, অত্যাচার ও দেশ পরিচালনায় চরম অদক্ষতাসহ মার্কিন প্রশাসনের কাছে প্রচন্ড নতজানু নীতির কারণে দেশবাসী চরম বিরক্ত হয়ে উঠেছে। সুতরাং যে দলটির নেতৃত্বে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে সেই দলটিকেই নিষিদ্ধ করে বর্তমান ইউনুস ও তার নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের চরম পাকিস্তানপ্রীতি ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ অপশক্তির অন্যতম দোসর ও আজ্ঞাবহ হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
২০২৪ এর আগষ্টে আওয়ামীলীগ সরকার ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে ‘ মেটিকুলাস প্ল্যান’ সুদখোর মহাজন ড. ইউনুস বাস্তবায়ন করেছিল সেই প্ল্যানেরই অংশ হিসেবে গত ১০ মে আওয়ামীলীগের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা দিয়েছেন মাত্র। নতুন কিছুই নয়। তবে বাংলাদেশের জনগণ শুধু সঠিক নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছে মাত্র এমনটাই মনে করছেন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা।
#নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, গবেষক।