ঢাকা: রাখাইন জনপদ ধ্বংস, দখলের মুখে। এমনকি আগের নামগুলো পর্যন্ত আর নেই। শ্মশানের জমি ও সাথে ধর্মীয় উপাসনালয় বিহারে জমিও বেদখলের শিকার।
এইধরনের একাধিক জনপদ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে , টেকনাফ এলাকায় রাখাইন গ্রামগুলো শেষ।
যুদ্ধকবলিত মিয়ানমার থেকে প্রাণে বেঁচে, নৌকা যোগে দরিয়া পাড়ি দিয়ে প্রায় আড়াইশ বছর আগে দক্ষিণের সাগরঘেঁষা জনপদ—পটুয়াখালীর রাঙাবালি উপজেলায় আসতে শুরু করে রাখাইনরা।
তখন এ অঞ্চল বসবাসের উপযোগী তো ছিলই না, এখানে ছিল হিংস্র প্রাণী আর জঙ্গলে ঘেরা। এরপর ধীরে-ধীরে শ্বাপদসংকুল এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে তোলে এই রাখাইনরাই।
জঙ্গল কেটে চাষবাসের উপযোগী করে জীবন-যাপন শুরু করে তারা। একসময়ে এই অঞ্চলে পঞ্চাশ হাজারের বেশি রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ থাকলেও এখন সাকুল্যে টিকে আছে আড়াই হাজার৷
দখল হয়ে গেছে রাখাইনদের বিঘার পর বিঘা কৃষি জমি। তাদের শ্মশান আর দেবালয়ও দখল হচ্ছে ক্রমাগত। মৃত্যুর পরে যে শ্মশানে যাবে সেটাও নেই। সেই জায়গাটুকুও দখল হয়ে যাচ্ছে।
বৌদ্ধবিহারের অধ্যক্ষ ইন্দ্রবংশ থেরো।
তিনি বলেন, “অনেক জমিজমার কাগজপত্র সে দুর্যোগের সময় হারিয়ে যায়। সেই সুযোগেই অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ ধীরে-ধীরে দখল নেওয়ার সুযোগ পায় এবং দখল নিতে থাকে। এরপর থেকে আস্তে-আস্তে রাখাইন কমে যায়। যারা ছিল, তারাও আস্তে আস্তে অন্য দিকে চলে যায়।
“তারা চিন্তা করে, এখানে প্রতিবছর জলোচ্ছ্বাস হয়, খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখানে কী করব। বেড়িবাঁধ হওয়ার পর ধীরে-ধীরে বাঙালিরা এসে বসতি গড়ে।”
ইন্দ্রবংশ বলছেন, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, ধীরে ধীরে দখল করে হয়ত তাদেরও তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মং ম্যা বলেন, “যেসব রাখাইন এখনও টিকে আছে এখানে, প্রায় সব পরিবারই এক বা একাধিক ভূমি সংক্রান্ত মামলায় লড়ছে।”
বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থায় ভূমি সংক্রান্ত মামলাগুলোকে দেওয়ানী মামলা বলা হয়। এসব মামলার রায় পেতে লাগে বছরের পর বছর। ফলে মামলা চালানোর মতো খরচ যোগাতে না পেরে অনেককে পাড়ি দিতে হয়েছে মিয়ানমারে।
এই কষ্টের শেষ কোথায়?
এমনকি আপনারা জানলে অবাক হবেন, বিলীন তো হয়েছেই, সেই সাথে পাল্টে গেছে রাখাইনদের গ্রামগুলোর নাম পর্যন্ত।
কোনো এক রাখাইন মাতবরের নামে যে পাড়াটির নাম ছিল ‘হুইচ্যানপাড়া’, ধীরে ধীরে সময় গেছে এবং উপকূলীয় শহর কুয়াকাটার এই পাড়াটির নাম হয়ে গেছে হোসেনপাড়া।
কুয়াকাটার কথা বলি!
ইন্দ্রবংশ বলেছেন, নাম পালটে যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কুয়াকাটা।
তিনি বলেন, “একেবারে শুরুর দিকে এই অঞ্চলের নাম ছিল ‘গাদলা’। এর অর্থ যেখানে মাছের নৌকা এসে ভেড়ে; অর্থাৎ ঘাট।
পরে যখন রাস্তাঘাট হল, উন্নত হল, তখন এখানে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার জন্য পর্যটকরা আসতে শুরু করে। এটাকে কেন্দ্র করে যখন কুয়াকাটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন এলাকার গণ্যমান্যরা চিন্তা করল, গাদলা নামটা কেমন!”
তিনি বলেন, “একসময় এ অঞ্চলে লবণাক্ত পানির জন্য খাবার পানির অভাব ছিল। তখন মিঠা পানির জন্য অনেক কুয়া খনন করা হয়।
এই বৌদ্ধবিহার ঘেঁষে যে কুয়া, সেটায় মিঠা পানি পাওয়া গিয়েছিল। তখন এ অঞ্চলের মানুষ বহু বছর এই কুয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল।
“ছোটবেলায় আমরা দেখেছি, এই পাড়ার মাতবর একটা চেয়ার নিয়ে বসে থাকত, এই পানিটাকে সবাই রশি দিয়ে তুলে নিত। তখন এই কুয়ার নামেই কুয়াকাটার নামকরণ করা হয়।”
এরকম আরো বহু নাম পাল্টে দেয়া হয়েছে। যার ফলে তাদের অস্তিত্ব আর নেই বললেই চলে।
দোকাসিপাড়ার হয়েছে দোভাষীপাড়া, আছালতখা হয়েছে আদালত খান, থঞ্জুপাড়াকে করা হয়েছে অঞ্জুপাড়া; অংথেনপাড়াকে করা হয়েছে অনন্তপাড়া।