রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধানের পক্ষ থেকেও বার বার বলা হচ্ছে- এ দেশ ধর্ম-বর্ণ-জার্তি নির্বিশেষে সবার। সংবিধান অনুযায়ী সবার সমান অধিকার। সবাই নির্বিঘ্নে-নিরাপদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বসবাস করতে পারবেন।

অতীতেও আমরা বার বার এ ধরনের সুন্দর সুন্দর বাণী শুনেছি। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। গত ২০২৪ এর ৫ আগষ্টে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেলো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-‌নির্যাতন-‌ধর্ষণ-ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুটপাট-দখল- খুন-হামলা-মামলা ইত্যাদি। ২০০১ এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরেও ঘটেছে।

বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়েও বার বার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা।সাম্প্রদায়িক এসব নির্যাতন-নিপীড়নের কত পরিসংখ্যান আর উদাহরণ দেয়া যায় বলুনতো! একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী হিসেবে এসব বলতেও নিজের কাছে নিজে ছোট হয়ে যাই।

যেসব হিন্দু ভাই-বোনদের সাথে একসাথে বড় হয়েছি, লেখাপড়া করেছি, এখনও কর্মক্ষেত্রে ও আশপাশে যেসব হিন্দু বন্ধু-বান্ধব আছেন তারাও কেমন যেন সিঁটিয়ে থাকেন কথা বলার সময়। এক ধরনের অবিশ্বাস-সন্দেহ তাদের মনে কাজ করে সে বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই টের পাই। এর জন্য আমরা যারা ইসলাম ধর্মাবলম্বী এই বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ তারাই তো অনেকাংশে দায়ী। এ বিষয়টি অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

রাজধানী ঢাকায় গত ১৬ আগষ্ট শনিবার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “এদেশ সবার, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনারা নিশ্চিন্তে এ দেশে বসবাস করবেন এবং আপনারা ধর্মীয় উৎসব আনন্দের সঙ্গে উদযাপন করবেন।”

সবাইকে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই দেশে শত শত বছর ধরে হিন্দু–-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান, পাহাড়ি-বাঙালি-উপজাতি সবাই মিলে আমরা অত্যন্ত শান্তিতে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে যাচ্ছি।

আজকের এই দিনে আমাদের অঙ্গীকার হবে সেই সম্প্রীতি, সেই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ আমরা সবসময় বজায় রাখব। এদেশ সবার, এদেশে আমরা সবাই শান্তিতে সুন্দরভাবে বসবাস করব। আমাদের পক্ষ থেকে যত ধরনের সহযোগিতা আপনারা চান ইনশাল্লাহ সেই সমস্ত সাহায্য-সহযোগিতা আপনাদেরকে দেবো।

তিনি বলেন, জন্মাষ্টমীর এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদর্শ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। এই আদর্শের ভিত্তিতেই আমরা একসঙ্গে সুন্দরভাবে বসবাস করব। অনুষ্ঠানে বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান ও নৌ বাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসানও প্রায় একই মনোভাব প্রকাশ করেন তাঁদের বক্তব্যে।

*চট্টগ্রামে সীতাকুন্ডে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ ধামে মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা!

একজন ব্যবসায়ী ও কওমী মাদ্রাসার অনুসারি চরম সাম্প্রদায়িক মনোভাবাসম্পন্ন এম এম সাইফুল ইসলাম ( M M Saiful Islam) তার ফেইসবুকে ১৭ আগষ্ট লিখেছেন-

সীতাকুন্ড পর্বতের চূড়ায় মসজিদ ৯০% কনফার্ম।

আলহামদুলিল্লাহ্!

তিনি চন্দ্রনাথ পাহাড় চূড়ায় ওঠাসহ বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন গতকাল সীতাকুন্ড পর্বতে উঠেছিলাম, চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে সুন্দর দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে বলুন?

আমিও তার ব্যতিক্রম নই,এরপর পর্বতে ওঠা। প্রথমে অনেকেই বলেছিলো হুজুর আপনার এই মোটা শরীর নিয়ে উঠতে পারবেন না, তবে আমি প্রথমেই বলেছি যদি ১ দিন সময়ও লাগে আমি চূড়ায় উঠেই ছাড়বো,প্রয়োজনে মাঝে মাঝে বিশ্রাম করবো। যেই কথা সেই কাজ। উঠতে উঠতে উপরে উঠলাম, তবে উপরে উঠার পর, যখন নামাজ পড়ার বিষয়ে কথা বললাম, সাফ জানিয়ে দিলো,তাদের পবিত্র ভূমিতে নামাজ পড়তে দিবে না এমনকি গত ২ বছর পূর্বে আজান দেওয়ার জন্য ২ জনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছিলো তা শুনিয়ে ভয় দিলো।

বিষয়টি খুব খুবই গয়রাতে লাগলো। এরপর এক একজন পর্যটককে নামাজের বিষয়ে বললে, সকলের একটাই আফসোস, যদি আমাদের জন্য একটি নামাজের জায়গা থাকতো,তাহলে আমাদের নামাজ ক্বাজা হতো না। পাহাড়ে উঠে মনোরম দৃশ্য দেখলাম এরপর পাহাড় থেকে নামলাম ঠিকই,কিন্তু কোন ভাবে মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। শুধু আফসোস করতেছিলাম, ৯৩% মুসলমানের দেশে, পাহাড়ের চূড়ায় পাশাপাশি ২টি মন্দির থাকতে পারে, আর আমরা সালার ভাড়াটিয়া, মসজিদ তো দূরের কথা নামাজ পড়ার অনুমতি পাই না !

হাটহাজারী মাদ্রাসায় গেলাম,ছাত্রদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম, রাতের খানাও শেষ করলাম,মাগার মাথা থেকে কোন ভাবেই নামাজের বিষয়টি ভুলতে পারলাম। ছাত্রদেরকে সাথে নিয়ে পরামর্শ করলাম কি করা যায়.? পরামর্শে সকলে শায়েখ ঐধৎঁহ ওুযধৎ সাহেবের সাথে কথা বলতে বললেন।

সাথে সাথে এ্যাকশন

ফজর নামাজের পর,হাটহাজারী থেকে সোজা, শায়েখের মাদ্রাসায়।

আলহামদুলিল্লাহ্

ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ্!

শায়েখ মাদ্রাসায় আসার সাথে সাথে সর্বপ্রথম ( Ashraf Ali Adnan) ভাই সরাসরি শায়েখের সাথে সাক্ষাৎ করালেন, হুজুর ইনি মুফতি সাইফুল ইসলাম, তার জুতার ফ্যাক্টরি রয়েছে খুব ভালো জুতা বানায়,আমিও ব্যবহার করি, শায়েখ ব্যবসায়ী শুনে খুব খুশী হলেন দোয়া করলেন, আলেম ব্যবসায়ী অনেক প্রয়োজন। আমি পিছনে পিছনে যাচ্ছিলাম, শায়েখ একটি তাকাজা নিয়ে এসেছিলাম,বলবো ?

বলো বলো….

এরপর হুজুরকে গতকালের পূর্ণ ঘটনা খুলে বললাম, এবং বললাম ওখানে একটি নামাজের জায়গা প্রয়োজন। হুজুর সাথে সাথে বললেন মাওলানা সুন্দর তাকাজা নিয়ে এসেছেন। সুন্দর উদ্যোগ,তবে মসজিদ করতে তো অর্থের যোগান লাগবে। অকপটে বললাম শায়েখ টাকার ব্যবস্থা আমি করবো।

শুনার সাথে সাথে বললেন, এখানে মসজিদ করা আমার দায়িত্ব। আপনি টাকার ব্যবস্থা করেন,আমাকেও আর্থিক সহযোগী হিসাবে রাইখেন ইনশাআল্লাহ্ বাকি টাকার ব্যবস্থা আপনি করুন। আগামীকালই প্রশাসনের সাথে কথা বলে ফাইনাল করতেছি, মসজিদ অবশ্যই হবে ইনশাআল্লাহ্! মন্দিরের পাশে না হোক,আশপাশে হবেই ইনশাআল্লাহ্।

মন্দির থেকে সামান্য নিচে, বটবৃক্ষের গোড়ায় মসজিদ হবে ইনশাআল্লাহ

শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

উদ্যোগটি ভালো লাগলে পোস্টটি শেয়ার করে দিবেন।”

পাঠক চিন্তা করে দেখুন এই মৌলানা সাহেবদের চিন্তাভাবনা !

একটু বলে রাখি আপনাদের জ্ঞাতার্থে- এই মুফতি হারুন বিন ইজহার হচ্ছেন লালখানবাজারে পাহাড়শীর্ষে অবস্থিত ‘ জামেয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসা’র প্রতিষ্ঠাতা ও মহাপরিচালক মুফতি ইজহারুল ইসলামের পুত্র।

এরা পিতাপুত্র উভয়েই আন্তর্জাতিক ইসলামী জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জেহাদ ও লষ্কর-ই-তৈয়বা’র সঙ্গে জড়িত। এই মাদ্রসাতেই ২০১১ সালের ৭ অক্টোবর বোমা বানানোর সময় বিকট শব্দে বিষ্ফোরণ ঘটে। মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে বোমা বানাতে গিয়ে তিনজন নিহত হয়, যাদের মধ্যে একজন ইসলামী ছাত্র শিবির ক্যাডার ও বোমা তৈরীর কারিগর ছিলেন বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন। ঘটনার পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গানপাউডার ও বারুদসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করেছিল তখন।

এ ঘটনায় এই পিতাপুত্র উভয়ের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের ও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এরা দুজনেই কিন্তু হেফাজতে ইমলামীর প্রভাবশালী নেতা। পাকিস্তান-আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন ইসলামী দেশের জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে এবং এরা জঙ্গী ট্রেনিংও নিয়েছেন।

তবে উভয়েই এখন কারামুক্ত ও নানা ষড়যন্ত্র করছেন বর্তমান ইউনুস সরকারের আমলে। কারণ তাদের এখন প্রচন্ড সুসময়।

*নানা প্রতিক্রিয়া মুসলিম-হিন্দুসহ সবার মধ্যে।

এম এম সাইফুল ইসলামের এই পোষ্টটি পড়ার পর সাংবাদিক আহমাদ ইশতিয়াক তার ফেইসবুকে লিখেছেন- “ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ তৈরি তো পরের কথা, ওখানে মসজিদ তৈরির চিন্তাও যে কতোটা ভয়ঙ্কর অপ-তৎপরতা তা খুব সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে।

প্রায় ৪ বছর আগে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আজান দিয়ে অনেকে সেই চেষ্টা চালাতে চেয়েছিল। তখনও মসজিদ তৈরির অপতৎপরতা চলেছিল যদিও তা শেষমেশ থেমেছে।

চন্দ্রনাথ পাহাড় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানগুলোর একটি। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে চন্দ্রনাথ পাহাড় অন্যতম। গত ৮০০ বছর যাবৎ চন্দ্রনাথ পাহাড়ের শিব মন্দিরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হচ্ছে।সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে বাংলাদেশে মোট ৭টি শক্তিপীঠ রয়েছে।

এগুলো হলো বরিশালের সুগন্ধা, বগুড়ার ভবানীপুর, সাতক্ষীরার যশোরেশ্বরী, সিলেটের দক্ষিণ সুরমার শ্রীশৈল ও কানাইঘাটের জয়ন্তীয়া, চট্টগ্রাম শহরের চট্টেশ্বরী ও সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় চূড়া।

আর চন্দ্রনাথ পাহাড় যে কেবল একটি শক্তিপীঠ বা মন্দির তাও না। পৌরাণিক ইতিহাস অনুযায়ী ওখানে মহামুনি ভার্গব বসবাস করতেন। সত্যযুগে অযোদ্ধার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র তার বনবাসের সময় এখানে এসেছিলেন। রাম সীতার বনবাস এর বেশ কিছু চিহ্ন পাওয়া যায় সীতাকুন্ডে।

তারা আসবেন জানতে পেরে মহামুনি ভার্গব এখানে স্নানের জন্য তিনটি কুন্ড (কুয়া) সৃষ্টি করেন। এরপর রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতা এই কুন্ডে স্নান করেন। এরপর থেকেই স্থানের নামকরণ করা হয় সীতাকুন্ড। যেটিতে রাম স্নান করেছিলেন সেটির নামকরণ করা হয় রামকুন্ড। রয়েছে লক্ষণ কুন্ড ও রামের ভক্ত হনুমান মন্দির।

পৌরাণিক স্মৃতিবিজড়িত অসংখ্য মঠ-মন্দির আছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। এখানে ক্রমদিশ্বর স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির রয়েছে। মূলত এই মন্দির দর্শন করে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আরোহন করতে শুরু তীর্থযাত্রীরা। মোটকথা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের প্রতিটি প্রান্তে প্রান্তে , পাহাড়ের খাঁজে, খাঁজে, ভাঁজে, ভাঁজে তীর্থস্থান।

চন্দ্রনাথ পাহাড় ও এর ভাঁজে ৭টি মন্দির ও ৬টি ধর্মশালা আছে। তার মানে বোঝাই যায় এই পাহাড় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে কতোটা পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ।

এরপরও আপনি যেহেতু যুক্তি মানবেন না, যেহেতু চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ তৈরির চিন্তাকে কোন অপরাধ মনে করছেন না, বরং সাফাই গাইছেন তাই আপনার কাছে একটা প্রশ্ন কোনো সনাতন ধর্মাবলম্বী যদি জাবালে রহমত, জাবালে নূর কিংবা উহুদ পাহাড়ে গিয়ে বলে জাবালে রহমত পাহাড়ের চূড়ায় গীতা পাঠ করবেন। ওখানে মন্দির বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবং বললেন অতি শীঘ্রই সেখানে হিন্দুত্ববাদের পতাকা উড়বে। বলছি আমার আপনার তখন কেমন লাগবে? তখন কি ৩৬০ ডিগ্রি বাঁক পরিবর্তন করবেন না তো?

নামাজের জন্য বহু জায়গা আছে, মসজিদ নির্মাণের এদেশে বহু জায়গা আছে। যদি কারো নামাজ পড়তে ইচ্ছে হয় তাহলে যেখানে ইচ্ছে পড়তে পারে। কিন্তু একটি ধর্মের তীর্থস্থান তথা সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর একটিতে কোনভাবেই মসজিদ হতে পারেনা।

উদ্দেশ্যমূলকভাবে যারা ধর্মকে ব্যবহার করে এ ধরণের অপতৎপরতা চালাতে যাচ্ছে তারা এদেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এটি যে কতো বৃহৎ চক্রান্ত তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এদের কাজই হলো এই ধরণের বিষয় সামনে টেনে এনে অস্থিতিশীল করা।

প্রতি বছর শিবচতুর্দশী রাত্রি ও মেলা উপলক্ষ্যে কেবল তিন দিনেই তীর্থযাত্রী সহ প্রায় ১৫ লাখ ভক্ত সীতাকুন্ডে আসেন। সরকার প্রতি বছর তীর্থযাত্রী ও দর্শনার্থীদের জন্য স্পেশাল ট্রেন ও বরাদ্দ রাখছে।

সরকার চন্দ্রনাথের বিষয়টি সবই জানে। পবিত্র তীর্থস্থানে মসজিদ বানানোর অপচেষ্টা তো দূরের কথা কেউ যাতে এখন তো বটেই ভবিষ্যতেও যেন এ ধরণের দুঃসাহস কেউ না দেখাতে পারে এজন্য সরকারের কড়া বার্তা দেয়া উচিৎ।”

*সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-ধর্মের নাগরিকরা তাদের নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এমন অনেক প্রতিক্রিয়া থেকে দেখা যায় তাদের অধিকাংশের বক্তব্য হচ্ছে- “ মুসলমানদের কোনো পবিত্র তীর্থস্থানে গিয়ে এমনই কোনো ধর্মান্ধ হিন্দু মৌলবাদীরা যদি মন্দির বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়! সেটা কি গ্রহণযোগ্য হবে ?

সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড় প্রাচীন কাল থেকেই হিন্দুদের পবিত্র শক্তিপীঠ। তাছাড়া এটি ছিলো বাংলাদেশে হিন্দুধর্মালম্বীদের জাতীয় তীর্থস্থানের মধ্যে অন্যতম। সেই পাহাড়টিকে ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র বানানোটাই ছিলো সর্বপ্রথম ভুল সিদ্ধান্ত। যার ফলে মাথামোটা সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ কিছু মানুষ সেখানে গিয়ে কোনো কারণ ছাড়া চন্দ্রনাথ মন্দিরের আশেপাশেই আযান দেয়ার নেশায় পড়ে যায়! তারই ফলাফল স্বরূপ এখন সেই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওই ধর্মান্ধ গাবড়দের প্রধানরা। যাদের কাজই হচ্ছে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করা!!

আমাদের প্রশ্ন হলো, চন্দ্রনাথ পাহাড়ে আযান না দিলে, মসজিদ বানিয়ে নামাজ না পড়লে কি ইসলাম ধর্মের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে ? তাছাড়া গোটা দেশে এতো হাজার হাজার মসজিদ থাকার পরেও হিন্দুদের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়েই মসজিদ বানানো এতো বেশি প্রয়োজন কেন ? শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানদের দেশ বলা হয় বাংলাদেশকে। হিন্দু তো এইদেশে প্রায় নাই বললেই চলে। যে কয়টা মন্দির আছে, সবগুলো কোনো ভাবে ইজ্জত-সম্মান বাঁচিয়ে চালানো হচ্ছে।

হিন্দুরা বেশি কথা বললেই তো চিন্ময় দাসের মতো ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী’ বানিয়ে জেলে ভরে রাখা হবে। আর যেকোনো সময়ে গিয়ে যেকোনো কারণে মন্দিরসহ হিন্দুদের বাড়ি ঘর ভেঙে দিয়ে বলবে, ‘অমুক হিন্দুর ব্যাটা ইসলাম ও নবীর অবমাননা করছে’ ! এটাই একমাত্র পয়েন্ট, যেখানে গোটা বাংলাদেশের আইন-কানুন-সরকার-৯০ ভাগ জনগণ সবাই চুপ!

এই চন্দ্রনাথ পাহাড় শক্তিপীঠের তীর্থস্থানকে ঘিরে ‘পর্যটন কেন্দ্র’ বানানোর সিদ্ধান্তই আজকে সেখানে মসজিদ বানানোর সিদ্ধান্তকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। কোনো ধর্মীয় স্থান কেন পর্যটনের জায়গা হবে? বাংলাদেশে পর্যটনের জায়গার এতো অভাব? এই কথা সেসময় কেউ শুনেনি।

ফলে আজ থেকে ৫০ বছরের মধ্যেই দেখবেন সেখানে মন্দির সরিয়ে ফেলা হবে, এবং এই ধর্মান্ধ মৌলবাদীরাই বলবে ওইটা মসজিদেরই পাহাড় এবং ওখানে কোনো মন্দির রাখা হবে শিরক ! এরপর কিছু ধর্মান্ধ উগ্র মৌলবাদী গিয়ে ওই মন্দির ভেঙে শ্লোগান দেবে- ‘নারায়ে তাকবীর ! আল্লাহু আকবর !

*বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কি বলেন সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে গত ১৬ আগষ্ট চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন বিএনপি প্রভাবশালী নেতা সাবেক মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি সেখানে বলেছেন-“ অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া আমি পছন্দ করিনা। এই কথাটা কেন বলতে হবে ? এখানে যখন অসাম্প্রদায়িক কথাটি বার বার বলা হয় তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে কোন গলদ আছে। আমরা সবাই বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী আমাদের সবার সমান অধিকার।

কেউ যদি সাম্প্রদায়িক হয় সে কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে কাজ করছে বা কথা বলছে, সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করার পায়তারা করছে। সংবিধানতো সবাইকে সমান অধিকার, নাগরিক-রাজনৈতিক-গণতান্ত্রিক অধিকার দিয়েছে। তাই আমাদেরকে এই গলদ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”

*বিশ্বাস কি আশ্বাসে !

কিন্তু প্রশ্ন হলো সত্যিকার অর্থেই কি জনাব আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ কথায় বিশ্বাস করেন ? তাহলে ২০০১ এর অক্টোবরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সারাদেশে যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন-খুন-ধর্ষণসহ নানা মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চালানো হলো তখন তাদের সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছিল ?

একটি বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তাহলো ২০০১ এর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল তা নিয়ে ‘ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ’ ১৫০০ দিনের ওপর একটি বিবরণ তুলে ধরেছিল। এসব তথ্য ও ছবি নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে ও বিদেশে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ থেকে। মূলত সংবাদ ভিত্তিক একটি কম্পাইলেশন।

বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান ব্যক্তিগণ কি সত্যিই বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন? অতীতে বা নিকট অতীতে কি তারা তা করেছেন বা আদৌ কোন সদিচ্ছা তাদের ছিল?

যদি থাকতো তাহলে চিন্ময় দাসের মত একজন সংসারত্যাগী সাধুকে আজ কারাগারে পচতে হতো না। শুধু চিন্ময় দাস নয়, এমন আরো অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিক বিনা অপরাধে-বিনা বিচারে কারাগারে। তাদেরকে কোন আইনী সহায়তাও দেয়া যাচ্ছেনা।

আদালতে তাদের পক্ষে জামিনের আবেদন করলে তা বার বারই বিএনপি-জামাত-এনসিপি সমর্থিত মৌলবাদী-ধর্মান্ধ আইনজীবীদের ‘ মব সন্ত্রাসে’ বা ওপরের চাপে আদালত নাকচ করে দিচ্ছেন।

তাহলে রাজনৈতিক নেতা ও দেশের সশস্ত্র বাহিনীর কর্তাব্যক্তিগণ কেন মিছে আশ্বাস দিচ্ছেন ?!

*সীতাকুন্ড উপজেলা প্রশাসনের ফেইসবুকে বক্তব্য।

রবিবার ১৭ আগষ্ট সন্ধ্যা আটটার দিকে এটি ফেইসবুকে দেখা গেছে।

এতে বলা হয়েছে- “ সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে করা একটি ফেসবুক পোস্ট আমাদের নজরে এসেছে। গতকাল পোস্টটি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

পোস্টটিতে দাবি করা হয়েছে যে, এ বিষয়ে আজ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি।

সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত বিভিন্ন মন্দির উপমহাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে পরিগণিত। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে পুণ্যার্থীরা নিয়মিত এ পাহাড় ও মন্দিরসমূহে দর্শন ও পূজা-অর্চনার জন্য আগমন করেন।

সীতাকুন্ড উপজেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে সকল ধর্মের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। পবিত্র তীর্থস্থানটির প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অনুভূতি ও আবেগকে সীতাকুন্ডবাসী গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে থাকে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে এমন কোনো কর্মকান্ডকে সীতাকুন্ডবাসী কখনোই সমর্থন করে না।

আজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে, এবং সেখানে মসজিদ নির্মাণের কোনো উদ্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলকে আশ্বস্ত করা যাচ্ছে, চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকায় মসজিদ নির্মাণের কোনো অনুমতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব, প্রোপাগান্ডা বা অপপ্রচার ছড়িয়ে সীতাকুন্ডে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নষ্ট করার যে কোনো অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সবাইকে অনুরোধ করছি, আমাদের সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখুন। ধর্ম-বর্ণের ভিন্নতা যেন বিভেদের কারণ না হয়ে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। আসুন, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের সুন্দর উদাহরণ গড়ে তুলি।”

এখানেও প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে যায়। কারণ অতীতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্যের জন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীসহ অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কেই নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে ও হচ্ছে। মিথ্যে ও ভুয়া ফেইসবুক পোষ্টের মাধ্যমে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কথিত ‘ ধর্মীয় অবমাননা বা উষ্কানিমূলক মন্তব্যে’র অভিযোগে উল্টো হয়রানি, হামলা-মামলা-প্রাণনাশের শিকার হতে হয়েছে।

# রাকীব হুসেইন, লেখক, প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *