ঢাকা: ঢাকা থেকে নিখোঁজের একদিন পর বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারের মরদেহ শুক্রবার মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করে নৌপুলিশ।

রাষ্ট্রীয় মদদে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তি কর্তৃক এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।

এবং আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ তদন্তসহ হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছে।

অন্যান্য দিনের মতো বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে তিনি রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে আজকের পত্রিকার কার্যালয়ের (বনশ্রী) উদ্দেশে রওনা হন। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খুঁজে পাওয়া যচ্ছিল না।

বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ গভীর শোক প্রকাশের পাশাপাশি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, বিশিষ্ট সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী বিভুরঞ্জন সরকারের নির্মম অস্বাভাবিক মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত ও স্তম্ভিত।

অবৈধ ও অসাংবিধানিক দখলদার ইউনুস সরকারের রাষ্ট্রীয় মদদে একাত্তরের পরাজিত দোসর সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তি জামাত-শিবিরের দেশব্যাপী গুম, হত্যা ও নির্যাতনের কারণে দেশের সকল স্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষক, সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীরা বর্তমানে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন।

তারা ক্রমাগত হুমকি, নির্যাতন, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন। বিভুরঞ্জন সরকার-এর জীবন ও কর্ম ছিল মানবিকতা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক।

তিনি নির্ভীকভাবে সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তাঁর এই নির্মম অস্বাভাবিক মৃত্যুতে শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির জীবনসংহার নয়, বরং এটি স্বাধীন গণমাধ্যম, মুক্ত চিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম, সত্য ও ন্যায়ের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার গভীর ষড়যন্ত্র।

অবিলম্বে সিনিয়র সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের হত্যাকারীদেরকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চলতি মাসে বঙ্গবন্ধু ও ২১ আগস্ট নিয়ে বেশ কয়েকটি কলাম লিখেছিলেন বিভুরঞ্জন।

এরপর তাঁকে অফিসে এসে হুমকি দিয়ে যায় ইউনূসের মদদপুষ্ট রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী বাহিনী। গত ১৬ আগস্ট থেকে ছুটিতে ছিলেন বিভুরঞ্জন সরকার।

অফিস তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় ওই হুমকির কারণে। শেষ পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ এই সাংবাদিককে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

অনলাইন গণমাধ্যম বাংলাট্রিবিউনে গত ১৮ আগস্ট একটি কলাম লিখেছিলেন বিভুরঞ্জন। সেখানে তিনি প্রথম দিকে তিনি লেখেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মহত্তম চেতনায়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক সমাজ গড়ার। কিন্তু সেই রাষ্ট্রপথ খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের সূচনা হলো, সেটিই আসলে এই দেশে সহনশীলতা ও মানবিক রাজনীতির মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিলো। হত্যার পরপরই সংবিধান পরিবর্তন, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের পুনর্বাসন এবং সামরিক স্বৈরশাসনের উত্থান ঘটলো।

এর ফলে রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এলো প্রতিশোধ, ষড়যন্ত্র ও প্রতিদ্বন্দ্বীকে মুছে দেওয়ার প্রবণতা। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছরেই দেখা যায়, রাজনৈতিক অঙ্গনে মতবিরোধ থাকলেও বঙ্গবন্ধু বিরোধী পক্ষদের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতেন, যুক্তি দিয়ে তাঁদের মোকাবিলা করতেন। কিন্তু তাঁর হত্যার পর নতুন শাসকেরা ভিন্নমতকে আর রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে স্বীকার করলো না। শুরু হলো নিষিদ্ধকরণ, দমননীতি এবং দমনপীড়নের রাজনীতি।

আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হলো, অনেক নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হলো, আবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াত ও পাকিস্তানপন্থিদের রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনা হলো। এই উল্টোপথে চলার ফলেই সমাজে সহনশীলতা ভেঙে পড়তে শুরু করলো।”

একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি জামায়াত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে সিনিয়র সাংবাদিক বিভুরঞ্জনকে রাষ্ট্রীয় মদদে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বর্তমানে দেশে কোন শ্রেণীর পেশার মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। কোন মানুষ স্বাধীন ভাবে তার মত প্রকাশ করতে পারছেন না। অবৈধ ও অসাংবিধানিক দখলদার ইউনুস সরকার তার জঙ্গি মব বাহিনীকে দিয়ে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এক গভীর সংকটে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের চাপ, মব ভায়োলেন্স এবং সাংবাদিকদের ওপর অনবরত হুমকির কারণে দেশের সংবাদমাধ্যম কার্যত প্যারালাইজড হয়ে পড়েছে।

বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল থেকে সাংবাদিক ছাঁটাই, এক্রিডিটেশন বাতিল, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ ও রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নে মিডিয়া ব্যবহার—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও সম্প্রচারমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতার ওপর এক ঘনীভূত কালো মেঘ জমেছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর সময় টিভি থেকে চাকরিচ্যুত হন প্রধান বার্তা সম্পাদক মুজতবা দানিশ, চিফ আউটপুট এডিটর লোপা আহমেদ ও অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর খান মুহাম্মদ রুমেল।

আরেক দফা চাপ আসে ১৮ ডিসেম্বর, যখন রাজনৈতিক নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ সিটি গ্রুপের এমডির সঙ্গে দেখা করে ১০ জনের নাম সম্বলিত একটি তালিকা দেন এবং তাদের চাকরিচ্যুতির জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ মব ভায়োলেন্সের হুমকি দেন।

একই দিন তালিকাভুক্ত পাঁচজনকে পদত্যাগ করতে বলার পর হোয়াটসঅ্যাপে তাদের বরখাস্তের নোটিশ পাঠানো হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের প্রতিবাদ লিপি ছাপানোর কারণে অবৈধ ও অসাংবিধানিক দখলদার ইউনুস সরকারের অবৈধ প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্পাদককে ফোন করে হুমকি দিয়ে কালের কণ্ঠের মেধাবী সাংবাদিক সজীব ঘোষকে চাকরিচ্যুত করেছে।

শতশত সাংবাদিককে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছে।

একের পর এক এসব ঘটনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে, সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে তথ্য অধিদপ্তর (পিআইডি) ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ১৬৭ জন সাংবাদিকের এক্রিডিটেশন বাতিল করে।

আন্তর্জাতিক সংস্থা এইচআরডব্লিউ জানায়, জুলাইয়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে ১৪০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয় এবং ১৫০ জনের অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল করা হয়।

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়েছে ১৯ জনের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে প্রচারেও ব্যবহার হচ্ছে মিডিয়া। ঈদুল আজহার দিনে ইউনূসের সামনে এক ব্যক্তির স্যার, আপনাকে পাঁচ বছর চাই বক্তব্য ছিল সুপরিকল্পিত।

এটি ছিল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের সাজানো নাটক। ভিডিওটি শফিকুল ইসলাম নামের এক কর্মকর্তা পোস্ট করার পর গণমাধ্যমে তা জোরপূর্বক ছড়ানো হয়। এই দৃশ্যমান কৌশল মূলত জনসমর্থন তৈরি ও আস্থা পুনরুদ্ধারে এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।

বাংলাদেশে গণমাধ্যম আজ আর কেবল সত্য তুলে ধরার মাধ্যম নয়—তা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক চাপ, ভয়ের সংস্কৃতি ও নিয়ন্ত্রণের শিকার এক পরনির্ভর প্ল্যাটফর্ম। যেখানে প্রশ্ন করার অপরাধে সাংবাদিককে চাকরি হারাতে হয়, সেখানে স্বাধীনতা কেবল এক অলীক ধারণা।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *