যে বাংলাদেশটির জন্ম হয়েছিল একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই বাংলাদেশটির এখন অবস্থা কি ?
আমরা গত এক বছর ধরে এদেশে আন্দোলনের নামে যে ছাত্র-তরুণদেরকে দেখে আসছি তা ভাবতেও এখন লজ্জা-ঘৃণা-ক্ষোভে মাথা হেঁট হয়ে আসে। মার্কিন ডিপষ্টেট আর জঙ্গী সর্দার নোবেলজয়ী ড. ইউনুসের মেটিকুলাস ডিজাইনের কোরবানী হয়েছে এদেশের ছাত্র-তরুণ সমাজ।
এদের মননে কোন দেশপ্রেম নেই, ইতিহাস জানার কোন আগ্রহ নেই। একরৈখিক কিছু চিন্তাভাবনা এদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে এরা বায়ান্ন মানেনা, তার পরবর্তী বাঙ্গালীর বিভিন্ন ধারাবাহিক বীরত্বপূর্ণ আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস ও সেইসব ইতিহাসের নেতা-নায়কদের মানেনা। এরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকেই মানেনা।
মুক্তিযোদ্ধাদের অসম্মান করছে বার বার। উপড়ে ফেলতে চাইছে এই বাঙ্গালীর শত বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও একাত্তরে নেতৃত্ব দেয়া বীর সেনানীদের।
শুধু কি তাই ? আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম দেশি-বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্র তথা পাক-মার্কিন ষড়যন্ত্রে চব্বিশের ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এদেশের ছাত্র-তরুণ সমাজের লুটপাটের বিভৎস দৃশ্য। এরাই নাকি চব্বিশের কথিত জুলাই গণ-আন্দোলনের সৈনিক ?
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে অবাধে লুটপাট। এমনকি মা-নানী-দাদীর সমান বয়সী মহিলার অন্তর্বাস পর্যন্ত এই জঙ্গী তরুণ-ছাত্ররা উল্লাসে প্রদর্শন করেছে, লুটপাট করেছে। ছি ! ছি! ছি ! বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ভেঙ্গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ভাষ্কর্য, মুর্যাল, বাঙ্গালী সংস্কৃতির যেসব স্থাপনা ছিল সবই ভেঙ্গেছে। ধানমন্ডিতে বাঙ্গালীর স্বাধীনতার সুতিকাগার হিসেবে পরিচিত বত্রিশ নম্বরে বঙ্গবন্ধু যাদুঘর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও সম্মতিতে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে। সারাদেশেই এসব করেছে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রী-তরুণ-তরুণীরা।
মা-বাবার পরে আমরা যাদেরকে স্থান দেই সেই শিক্ষকদেরকে চরমভাবে অপমান করেছে, কান ধরে ওঠ-বস করিয়েছে, শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পড়িয়েছে।
যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর- আলসামশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে তাদেরকে প্রতিনিয়ত চরমভাবে অপমান করছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের গলায়ও জুতার মালা পড়িয়েছে কথিত জুলাই আন্দোলনের এই নব্য রাজাকারেরা। এসব ছাত্র-তরুণদেরকে নব্যরাজাকার বলা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী, তাঁর ভাই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, বীর মুক্তিযোদ্ধা-রাজনীতিবিদ ফজলুর রহমানসহ সারাদেশেই এরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চরমভাবে লাঞ্ছিত-অপমানিত করছে।
অথচ তাঁরা এই দেশটিকে স্বাধীন না করলে এখনো সেই পাকিসেনাদের অধীনস্থ থাকতো এ ভূখন্ডের বাঙ্গালীরা। হয়তো বাঙ্গালী হিসেবে পরিচয়ও দেয়া যেতোনা। কিন্তু সব অস্বীকার করছে এই প্রজন্মের কথিত জুলাই যোদ্ধারা। আমিতো সরাসরি এদেরকে জঙ্গী হিসেবে আখ্যায়িত করি।
এদের আচরণ সম্পর্কে যদি বলতে যাই তাহলে লজ্জায়-ক্ষেভে-ঘৃণায় হৃদয় রক্তাক্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব জঙ্গী ছাত্র-ছাত্রী-তরুণ-তরুণীরা যেসব অশ্লীল স্লোগান দিয়েছে ও দিচ্ছে সেসব দেখছে ও শুনছে এ জাতি। সত্যিই এ জাতির চরম ধৈর্য্য দেখে অবাক হতে হয়।
সেদিন ঢাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আইনজীবী ফজলুর রহমানের বাসার সামনে পোষ্টারে লিখে মুখে যেসব শ্লোগান দিয়েছে তরুণ-তরুণী ও ছাত্র-ছাত্রীরা তা আর লিখতে চাইনা। অধিকাংশ মানুষই এসব দেখেছেন, শুনেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নাকি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় বা হতো। এর সঠিক কারণ আমার জানা নেই। যদি জ্ঞান বিজ্ঞানে অগ্রসারমানতার জন্য তা বলা হতো তাহলে এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়কে কি নামে “ সন্মানিত” করা হবে সেটাই ভাবছি।
কারণ সেখানকার শিক্ষার্থীরা বিএনপি দলীয় নীতিনির্ধারক তারেক রহমানকে উদ্দেশ্য করে শ্লোগান তুলেছে-‘ এক দুই তিন চার, তারেক রহমানের ( .. ) মার’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও নানা ধরনের অশ্লীল বাক্যবাণ, শ্লোগান শুনেছি আমরা।
সেদিন মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাসার সামনে যে কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী-তরুণ-তরুণী পোষ্টারে যে শ্লোগান লিখে ও উচ্চকিত কন্ঠে শ্লোগান দিয়ে অবস্থান করছিল তার জন্মপরিচয় নিয়ে সত্যিই সন্দেহ জাগে।
তার বা মা-বাবা বা অন্য কোন অভিভাবক বোধ হয় তাকে বা তাদেরকে এ শিক্ষাই দিয়েছেন ! তা নাহলে এ ধরনের সুন্দর-মধুর (!) শ্লোগান তারা শিখবে কোথায় ?
সেদিনই মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের বাড়ির সামনে এসব অশ্লীল পোষ্টারকে সামনে রেখেই বেশ কিছু হুজুর টাইপের তরুণকে নামাজও আদায় করতে দেখলাম। বাহ ! বাহ! কি সুন্দর নামাজ আদায় ! এই কি ইসলাম ধর্মের শিক্ষা -বড় জানতে ইচ্ছে করে। আমাদের ছাত্র-তরুণ সমাজ কোন ধারায় এগোচ্ছে তার নমুনাতো দেখতেই পাচ্ছি সবাই এই ইউনুসীয় জমানায়।
কিন্তু এই বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আগে-পিছে সবসময়েই মূল ভূমিকা পালন করেছিল এদেশের ছাত্র-তরুণ সমাজ। এটিতো অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। সেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথাই যদি ধরি, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, ব্রিটিশদের অস্ত্রাগার দখল- কারা করেছিল এসব ? নিশ্চয় বয়স্ক নাগরিকরা নন। এর নেপথ্যে ও সম্মুখভাগে নেতৃত্বে থেকে অসীম সাহসে অকুতোভয়ে দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দিয়েছেন ছাত্র-তরুণরা। তাদের মধ্যে লোভ-লালসা ছিলনা।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ে সে সময়কার ছাত্র-তরুণ সমাজ ছিল কষ্টিপাথরে যাচাই করা সাচ্চা দেশপ্রেমিক।
ব্রিটিশদের তাড়ানো হলো অবিভক্ত ভারতবর্ষ থেকে। দ্বিজাতিত্ত্ব বা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলো ভারত আর পাকিস্তান। কিন্তু সেই ভাগও সঠিকভাবে হলোনা। অনেক মুসলিম ভারতে রয়ে গেল, আবার অনেক হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানেই রয়ে গেল। তা পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান উভয় অংশেই। ফলে সমস্যা রয়েই গেল।
পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান ( বর্তমান বাংলাদেশ) এর ভৌগোলিক দূরত্ব ছিল এক হাজার মাইলেরও বেশি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আবারো শোষণ-নির্যাতন শুরু করলো বাঙ্গালী অধ্যুষিত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর। এর বিরুদ্ধে তখন রুখে দাঁড়ালো পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র-তরুণ সমাজ। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিলো কারা ? এই তরুণ সমাজইতো।
তারপর থেকে নানা আন্দোলন সংগ্রাম চলতেই থাকলো । ১৯৫৪ তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭ টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩ টি আসনে জয়লাভ করে। এর মধ্যে আওয়ামীলীগই পায় ১৪৩ টি আসন। শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন প্রাদেশিক পরিষদের মন্ত্রীসভায় শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি-বন ও সমবায় মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি যখন মন্ত্রী পদ লাভ করেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। তরুণ একজন রাজনীতিবিদ। কিন্তু তারও একবছর আগে অর্থাৎ ’৫৩ সালে শেখ মুজিব কিন্তু আওয়ামীলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অর্থাৎ তখন তাঁর বয়স ৩৩ বছর। এক প্রতিবাদী তরুণ তিনি তখন। কিন্তু প্রজ্ঞা, রাজনৈতিক মেধায় অনেক বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদের চেয়েও অগ্রসর ছিলেন- এটিতো অস্বীকার করতে পারবেননা কেউ।
এই ইতিহাসটি টানলাম এ কারণে যে এর পরবর্তী সময়েও সেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিবাদী ছাত্র-তরুণরা পশ্চিম পাকিস্তানী শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে বার বার। এদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে-সজাগ করেছে কৃষক-শ্রমিক মেহনতী খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদেরকে।
এরপর থেকে ১৯৬২ তে ছাত্র সমাজের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ তে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ তথা এদেশের গণমানুষের ৬ দফা আন্দোলন, এরপরে এলো ১৯৬৯ এর পাকিস্তানের আইয়ুব খান বিরোধী বাংলার মানুষের গণঅভ্যুত্থান। যে গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় আইয়ুব খানের।
আজকে ঢাকায় যে আসাদ গেট রয়েছে সেই গেটতো উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আসাদের স্মৃতিরক্ষার্থে , তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে করা হয়েছিল। এরকম আরো অনেক বীরত্বগাঁথা রয়েছে এ বাংলার ছাত্র-তরুণ সমাজের।
বাংলাদেশ সৃষ্টি, বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এসব ছাত্র-তরুণদের সংগ্রাম-আত্মত্যাগকে অস্বীকার করবে সে সাধ্য কার ?
’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আমরা পেয়েছিলাম তোফায়েল আহমেদ , আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, মাহফুজা খানম, রাশেদ খান মেনন, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আসম রব, সিরাজুল ইসলাম খান, শেখ মনি,আবদুল কুদ্দুস মাখন, নুরুল ইসলাম নাহিদ সহ আরো অনেক ছাত্র নেতাদের যারা পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনেক বড় অবদান রেখেছেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় ’৬৯ এর পরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে যেসব ছাত্র নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেই নব্বইয়ের ছাত্র-গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নেতৃত্ব খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারলেন না এদেশে সুস্থ ধারার রাজনীতিতে।
তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন, আমলা হয়েছেন-বিচারক হয়েছেন, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার সঙ্গে হয়তো যুক্ত আছেন অনেকেই।
কিন্তু দেশবাসীর আশা ছিল ’৬৯ এর পরে নব্বইয়ের ছাত্র-গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র নেতৃত্ব দেশের রাজনীতি ও দেশ পরিচালনার হাল ধরবেন শক্ত হাতে। নাহ সে আশায় গুঁড়েবালি। এখনো কেউ কেউ রাজনীতিতে আছেন ঠিকই কিন্তু রাজনীতিকে তারা রাজনীতিবিদদের হাতে রাখতে পারেননি।
এটি চলে গেছে একশ্রেণীর চোরাকারবারি-কালো টাকার মালিক-মাফিয়াদের হাতে। স্বাধীনতা পরবর্তী পচাত্তরের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে রাজনৈতিক সংকটের সময়ে সেই একাত্তরের পরাজিত ইসলামী সাম্প্রদায়িক শক্তি পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী কিছু দেশসহ মার্কিন মদদপুষ্ট হয়ে পুরো রাজনীতিকে ঘোলাটে করে তুলেছে।
পঁচাত্তর পরবর্তী জিয়া-এরশাদীয় শাসন-শোষণের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতিকে অত্যন্ত জটিল ও নোংরা করে ফেলা হয়েছে। ইসলামী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, সন্ত্রাসী, চোরাকবারবারি, অবৈধ টাকার মালিকরা রাজনীতিতে অত্যধিক প্রভাব রাখার সুযোগ পেয়ে তারাই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে।
আর সেই জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সামরিক শাসকরাতো সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে কাজে লাগিয়েছেন রাজনীতিকে উপরের ধারায় কলুষিত করার জন্য। ফলে সুযোগ-ফায়দা পেয়ে এই সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা অনেকটা মাথায় উঠে বসেছে। সেই সাথে যুক্ত হয়েছে বেসামরিক আমলানির্ভরতা প্রশাসন। দেশ চালাবেন রাজনীতিবিদরা, সংসদ সদস্যগণ।
সংসদ হবে সব গণতান্ত্রিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দু, সরকারিদল-বিরোধীদলের বাহাস হবে, যুক্তিতর্ক হবে, তার মধ্য দিয়েইতে একটি সমাধান বের হয়ে আসবে- এমন প্রত্যাশাই ছিল দেশবাসীর। চরম দুঃখের বিষয় -সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের সরকার পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত বড় রাজনৈতিক দলগুলো।
রাজনৈতিক দূরদর্শীতার এই শূন্যতায় নানা ছদ্মবেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের ওপর ভর করে পাক-মার্কিন গভীর ষড়যন্ত্রে দেশে ‘সামরিক জঙ্গী ক্যু’ হয়ে যাবে ?
আর পরপর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার পরিচালনায় যারা হার্ডকোর নেতা ছিলেন তারা কিছুই জানবেন না ! এমনটি হওয়ার কোন কারণ ছিলনা। কিন্তু অত্যন্ত করুণ ও অস্বাভাবিক হলেও তাই ঘটেছে।
কারণ রাজনীতি আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের মধ্যে ছিলনা। রাজনীতি চলে গেছে চোরাকারবারি-ভূমিদস্যু-মাফিয়া-সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের হাতে। আর নেপথ্যে ছিল দেশি বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্রান্ত।
যাক সেই ছাত্র-তরুণদের রাজনীতির জায়গায় আসি যা দিয়ে শুরু করেছিলাম। যেহেতু ছাত্র-তরুণ সমাজ সবসময়েই অন্যায়ের বিরুদ্ধে-অসাম্যের বিরুদ্ধে-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছিল সমাজে তাই তাদেরকেই সামনে রেখে দেশি-বিদেশী- আন্তর্জাতিক চক্র তাদের ষড়যন্ত্রের জালটি বিস্তার করেছে।
আর বিভিন্ন এনজিও নানা কৌশলে কাজ করেছে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে। দেশের বিভিন্ন ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোকে, ইসলামী জঙ্গীবাদকে অত্যন্ত সফলভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। আর জামায়াতসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহরিতো আছেই।
সামরিক-বেসামরিক-শিক্ষাঙ্গন সর্বক্ষেত্রে এরা অর্থ দিয়ে ও ইসলাম ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্তির বেড়াজালে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে যেটি মাথাচাড়া দিয়েছে সেটি হলো শিক্ষার্থী-তরুণদের মব সন্ত্রাস ও চরম বেয়াদবি। মব সন্ত্রাস করে, আওয়ামীলীগের দোসর বানিয়ে ( তাদের ভাষায় পতিত ফ্যাসিবাদ) ভয় দেখিয়ে হেন কোন অপকর্ম নাই যা তারা করছেনা।
সমাজের এতদিনকার যে নীতি-নৈতিকতা-শিক্ষা-আদব-কায়দা-সম্মানবোধ সবকিছুকেই শেষ করে দিয়েছে। খুন, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসসহ হেন কোন অপকর্ম নেই যা তারা বাদ রেখেছে। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার কোন পরিবেশ নেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের রাজনৈতিক দল এনসিপি, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির, কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক হেফাজতে ইসলামীসহ সবাই মিলেই দেশটিকে লুটপাট করে খাচ্ছে।
কিন্তু অত্যন্ত কৌশলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি ও তাদের দোসর পাকিস্তানী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অত্যন্ত কৌশলে ও বর্তমানে প্রকাশ্যেই তাদের অপতৎপরতা চালাচ্ছে বাংলাদেশের সরকার, রাজনীতি, সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
তাদের মূল উদ্দেশ্য হলো -একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙ্গালী সংস্কৃতি, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ-মুক্তিযোদ্ধা, মুক্ত চিন্তার বিকাশকে শুধু রুদ্ধ করা নয় একেবারেই বিনাশ করা। সেজন্যই এসব ছাত্র-তরুণ সমাজের মননে, মগজে-চেতনায় অশ্রাব্য ভাষা, জঙ্গীবাদী কর্মকান্ড ঘটানো হচ্ছে।
অবাক লাগে এইসব ছাত্ররাই নাকি আগামিতে নেতৃত্ব দেবে, দেশ শাসন করবে। অবশ্য এরাই একপ্রকার দেশ শাসন করছে। কয়েকটি প্রজন্মের লেখাপড়া, শিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা-দেশপ্রেম সবকিছুই শেষ করে দিয়েছে ও যা বাকী আছে তাও শেষ করে দিচ্ছে।
কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, এনসিপি, ছাত্র শিবির, ছাত্রদল এরা যদি বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণদের কাছে আদর্শ হয়, মডেল হয় তাহলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় তা বুঝতে আর নিশ্চয়ই অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
কারণ এরাই তো শ্লোগান দেয়- এক দুই তিন চার..(..) মার, টিনের চালে কাউয়া অমুক আমার ..(..)। বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও নানাভাবে পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্র থেকে বের হয়ে আসতে সাধারণ বাঙ্গালীদেরকেই সচেষ্ট হতে হবে। কোন বিদেশী শক্তি এই সমাজটিকে উদ্ধার করতে পারবেনা।
# ইশরাত জাহান, লেখক, নারী সংগঠক ও প্রাবন্ধিক।