চব্বিশের জুলাই-আগষ্টের জঙ্গী ক্যু এর ‘মাস্টারমাইন্ড’ মাহফুজ আলম এখন ইউনুসীয় সরকারের তথ্য উপদেষ্টা। যিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামী জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহরীর একনিষ্ঠ সংগঠক সেই তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ নাকি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন।

তিনি আইনও প্রণয়ন করে যেতে চান এই সরকারের আমলে। তাহলে তো আর সাংবাদিকদের কোন চিন্তা নাই ! কি বলেন আপনারা?

তার মানে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা যা ঘটেছে তাই লিখতে ও প্রচার করতে পারবেন এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে উপদেষ্টার কথায়। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে সেটা বোধ হয় নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা বাংলাদেশের নাগরিকদের।

এই সরকারের আমলেইতো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হয়েছে। সাংবাদিকেরা খুন করেছেন? গুলি করেছেন? বোমাবাজি করেছেন? চাঁদাবাজি করেছেন? যদি তা না হয় তাহলে এসব হাস্যকর ও নিতান্তই হয়রানিমূলক মামলা দেয়া কেন?

এই ড. ইউনুস ও তাঁর উপদেষ্টা পরিষদ চালিত সরকার যে কোন সভ্য সরকার নয় তার প্রমাণ হচ্ছে তাঁরা সংবাদমাধ্যমের শুধু গলা টিপে ধরে নাই। বরং গলা টিপে হত্যা করা বাকি রেখেছেন লোক দেখানোর জন্য।

‘কোরামিন’ ( জীবন রক্ষাকারি ওষুধ) দিয়ে কোনভাবে রোগীকে বাঁচিয়ে রেখে জাতি ও বিশ্বের কাছে দেখানো হচ্ছে- নাহ সাংবাদিকরা বেঁচে আছেন। আবার জঙ্গী নেতা মাহফুজ আলম বড় বড় গলায় বলছেন-তিনি এই সরকারের মেয়াদেই সাংবাদিকদের সুরক্ষা/ নিরাপত্তা আইন করে যাবেন।

কত বড় প্রতারক হলে এমনটি করা যায় সেটিই ভাবছি। শান্তিতে নোবেল বাগিয়ে নেয় ইউনুস যেমন বিশ্ব প্রতারক, তার পারিষদের অন্য সৈন্য-সামন্তরাও তেমনই ।

আপাতত শুধু এতটুকু বলে রাখি- এই সরকারের আমলে বিনা বিচারে জেল খাটছেন কমপক্ষে ১৫ সম্পাদক-সাংবাদিক। আর খুন, হত্যাপ্রচেষ্টা, বিষ্ফোরক দ্রব্য আইন, চাঁদাবাজি, প্রাণনাশের হুমকিসহ নানা অভিযোগে অন্তত ৩০০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

ফলে সাংবাদিকেরা মহা আতংকের মধ্যে আছেন।কারান্তরে নির্যাতিত সাংবাদিকেদের পক্ষে আদালতে কোন কিছু বলতেও দেয়া হচ্ছেনা। আর যেসব সাংবাদিকদের নামে মামলা রয়েছে নানা মিথ্যা অভিযোগে তারাও আগাম জামিন নেবেন তেমন কোন উপায়ও নেই।

তাদের মধ্যে অনেকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরেও যেতে পারছেন না। যাদেরকে কারা প্রকোষ্টে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে তাদেরকে জামিন দিলে কি তারা পালিয়ে যাবেন?

দরকার হলে তাদেরকে কিছু বিধিবদ্ধ আইনের মাধ্যমে জামিন দেয়া হোক।

হিযবুত তাহরির জঙ্গি নেতা ও তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আনাম কি বলেছেন তা একটু জেনে নেই। গত ৮ অক্টোবর তিনি বলেছেন-নির্বাচনের আগে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন নিশ্চিত করার ব্যাপারের সরকার কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

সেদিন বুধবার, ৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় সচিবালয় বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সঙ্গে বৈঠকের আগে একথা বলেন তিনি।

মাহফুজ আলম বলেন, ‘সাংবাদিকদের সুরক্ষা আইনের অধীনে প্রিন্ট মিডিয়ার পাশাপাশি টেলিভিশন কর্মীদেরও আনা হবে।’ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনসহ সবার সঙ্গে আলোচনা করে ওয়েজ বোর্ড বা বেতন কাঠামো নিয়ে সরকার সিদ্ধান্তে আসতে চায় বলেও জানান মাহফুজ আলম।

এসময় বিগত আমলে গণমাধ্যমের সমালোচনা করে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ‘আওয়ামী সরকার আমলে গণমাধ্যমগুলো গুম খুনের সংবাদ প্রকাশ করতো না।’

এমনকি গত ১৫ বছরে যতগুলো মিডিয়াকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে সবগুলোই রাজনৈতিকভাবে দেয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তথ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার আওয়ামী লীগের অধীনে দেয়া কোন টিভি চ্যানেল বাতিল করেনি, সরকার স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাসী।’

একইসঙ্গে নতুন আরও বেশকিছু চ্যানেলের আবেদন যাচাই বাছাই চলছে বলেও জানান তিনি।

তবে এরই মধ্যে কথিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখার অযুহাতে দুই এনসিপি নেতাকে নীতি-বহির্ভূত ভাবে ২টি টেলিভিশন লাইসেন্স অনুমোদন দিয়েছে ইউনুস সরকার। চ্যানেল দুটির নাম ‘নেক্সট টিভি’ ও ‘লাইভ টিভি’।

তবে যতদূর জানি, এ দুটোর মালিকানার নেপথ্যে রয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী। যে ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারি দেখানো হচ্ছে বা প্রকাশ পাচ্ছে তারা জামাতের লোক।

কিন্তু সেই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের নীতিইতো অনুসরণ করছে ইউনুস সরকার। তাহলে আর নতুন কিছু হলো ? কোথায় হে মহামান্য ইন্টেরিম- এমন প্রশ্ন তো দেখা দিয়েছে সবার মধ্যেই।

নতুন লাইসেন্স পাওয়া নেক্সট টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান তুহিন। লাইভ টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুর রহমান।

উপদেষ্টা মাহফুজ বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদমুক্ত গণমাধ্যম তৈরি এবং গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের সুযোগ সৃষ্টি করতেই লাইভ এবং নেক্সট টিভি নামে দুটো টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই চলছে, এই সরকারের মেয়াদে আরও টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সময় দেওয়া টেলিভিশনের লাইসেন্স সরকার বন্ধ করেনি, করবেও না। তাই গণঅভ্যুত্থানের অবদানকারীদের জন্য এটা সরকারের নতুন সুযোগ। সব ধরনের নীতিমালা মেনেই লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে।’– এ প্রসঙ্গে একটু করে বলতে চাই, টিভি বন্ধ করতে হবে কেনো? সবইতো চলছে আপনাদের আজ্ঞাবহ হয়ে।

হে ইন্টেরিমের তথ্য উপদেষ্টা আপনার কাছে একটু জানতে চাই- কোন সংবাদমাধ্যম কি আপনাদের বিরোধিতা করে কোন সংবাদ প্রচার করতে পেরেছে সেই কথিত গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে?

এই বাংলাদেশে চেনা মাস্তান, অচেনা মাস্তান-সন্ত্রাসী কারনে অকারণে সাংবাদিকদের পেটায়, রক্তাক্ত করে, খুন করে,গুম করে। হর হামেশাই সাংবাদিকদের উপর সন্ত্রাসী, কথিত জনপ্রতিনিধি, পুলিশের হাত উঠছে। সাংবাদিকরা খুন হচ্ছে। এভাবে চলে না।

সাংবাদিক হত্যা-নির্যাতন আর কত সইবে জাতি? আর কত রক্ত ঝড়বে জাতির বিবেকের? অপকর্মের সংবাদ প্রকাশ হলে সরকারি দল, বিরোধী দল সাংবাদিকের উপর চড়াও হয়। রাজপথে পুলিশ পেটায়।

পুলিশ ও মাদক ব্যবসায়ী সাংবাদিকের পিছু নেয়। সাংবাদিকরা আহত হলে, নিহত হলে সমব্যথী সাংবাদিক ব্যানার হাতে রাস্তায় নামে।

পুলিশ প্রশাসনের লোকজন, রাজনীতিবিদ ছুটে আসেন, সান্ত্বনা দেন এই পর্যন্তই। আশ্বাস মেলে ভুঁড়ি ভুঁড়ি। সান্ত্বনার বাণী, আশ্বাস মিললেও বিচার মেলে না। এই বিচারহীন সংস্কৃতিই সাংবাদিক নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।

সাংবাদিকদের প্রচারিত সংবাদের সত্যতা যাচাই না করে এবং প্রেসকাউন্সিল এ্যাক্ট আমলে না নিয়ে যদি সরাসরি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়ার বিধান রাখা হয় তাহলে যখন-তখন যে কেউই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দিতে দ্বিধা করছে না।

সাংবাদিক পেটালে, খুন করলে যদি কিছু না হয়, তাহলেতো রাস্তা ঘাটে সাংবাদিকরা মার খাবেই, খুন হবেই। তাই আজ সাংবাদিকতা পেশার নিরাপত্তা খুব জরুরী। সাংবাদিক যেহেতু রাষ্ট্রেরই একজন, কাজেই সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।

এ দায়িত্ব সরকারকে যথাযথভাবে পালন করতেই হবে। কিন্তু সেই রাষ্ট্র যখন স্বয়ং নিপীড়কের ভূমিকা পালন করে তখন উপায় কি ? কোন উপায় নেই । ধুঁকে ধুঁকে মরা ছাড়া। এমনটিই চলছে এই বাংলাদেশে।

সম্প্রতি টিআইবির প্রতিবেদনে সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন, হয়রানির যে চিত্র উঠে এসেছে, তা আরো উদ্বেগের। টিআইবির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত এক বছরে (আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫) ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৬৬ জনকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে।

দায়িত্ব পালনকালে তিনজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। কমপক্ষে ২৪ জন গণমাধ্যমকর্মীকে পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে, ৮টি সংবাদপত্রের সম্পাদক এবং বরখাস্ত করা হয়েছে ১১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের বার্তাপ্রধানকে।

আমরা মনে করি, গণমাধ্যমের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে তা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিতকে আরও মজবুত করবে। তাছাড়া সাংবাদিকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্বতো রাষ্ট্রেরই।

অথচ আমাদের দেশে আজ পর্যন্ত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো দূরে থাক, কোনো সাংবাদিক হত্যাকান্ডেরই বিচার হয়নি বলে অভিযোগ উঠছে হরদম।

*ইউনুস সরকারের ঘরের সাংবাদিক মাহফুজ আনামও ক্ষিপ্ত !

দেশকে বিরাজনীতিকরণের অন্যতম কারিগর-সাংবাদিক যমজ হলেন মতি-মাহফুজ। মানে প্রথম আলোর সম্পাদক+মালিকানার অংশদার মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টারের সম্পাদক+ প্রকাশক মাহফুজ আনাম। এই জুটি সেই ২০০৭ থেকেই বাংলাদেশের সরকারকে তাদের আজ্ঞাবহ রাখতে সচেষ্ট ছিলেন।

তারা রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ছনিয়ে নিয়ে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতেই তুলে দিতে অত্যন্ত সুচতুরভাবে ষড়যন্ত্র করে আসছেন। তা বোধহয় তারা ২০২৪ এ এসে সফল হয়েছেন অনেকটা। সেই মাহফুজ আনামই সম্প্রতি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, গণহারে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিপন্থি এবং এটি ভয়ের ব্যাপার।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব?’

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামল এত জনধিক্কৃত হয়েছিল, তার অন্যতম কারণ ছিল গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ছিল না। আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং আরও অনেক আইনের শিকার হয়েছি।

তবে বর্তমানে ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে মামলা চলছে। এটা কীভাবে সম্ভব? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ২০০ বা কিছু বেশি সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।

২৬৬ জন সাংবাদিক আজকে খুনের মামলা অথবা সহিংসতা–সংক্রান্ত অপরাধের মামলার আসামি। এটা আমাদের জন্য অসম্মানের।’ মেনে নিলাম মামলা করা অধিকার; কিন্তু কোনো আইনের যদি অপপ্রয়োগ হয়, তাহলে কি সরকার কিছু করবে না? সেখানেই আমার বড় প্রশ্ন।’

১৩ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার আছেন উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘তারা যদি অপরাধ করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু আজকে সাত মাস, আট মাস ধরে কারাগারে, তারা জামিন পাচ্ছেন না। তাদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া চলছে না। বিচার হচ্ছে না। তাহলে এটা কি চলতে থাকবে!’

করণীয় সম্পর্কে নিজের মতামত তুলে ধরে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে, সরকার হয়তো অনেক ব্যস্ততার জন্য এই ২৬৬ সাংবাদিকের মামলা দেখতে পাচ্ছে না।

কিন্তু তারা দৈবচয়ন ভিত্তিতে ১০-১৫টি মামলা দেখুক না, যেখানে ২০-২৫ জন অভিযুক্তের মধ্যে একজন-দুজন সাংবাদিক আছেন। তারা যদি একটা, দুইটা, পাঁচটা দৃষ্টান্ত পায় যে সাংবাদিকদের নামে হওয়া মামলা মিথ্যা মামলা, তাহলে কেন পদক্ষেপ নেবে না?

বারবার বলা হয় আমাদের কিছু করণীয় নাই, আমি মনে করি যারা এই মামলা দিয়ে সাংবাদিকদের হেনস্তা করছেন, এতে তাদের আরও বলিষ্ঠ করা হয়। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আমি দাবি করছি, সরকার সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াক।’

*শ্যামল দত্ত-মোজাম্মেল বাবু-শাকিল-রুপা দম্পতি, মনজুর আলম পান্নারা কি খুনী?

দেশের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল ছিল একাত্তর টিভি। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলতো সরাসরি, কোন রাখঢাক না করেই। এটির মূল পরিচালনা ব্যক্তি ছিলেন মোজাম্মেল বাবু। যতদূর জানি মোজাম্মেল বাবু ক্যানসার আক্রান্ত।

শাকিল আহমেদ ও ফারজানা রুপা সেখানে কাজ করতেন। এই তিনজনই এখন ইউনুসীয় সরকারের রোষানলে পড়ে কারাগারে। রুপার মা মারা যাওয়ার পর তাকে প্যারোলে বোধ হয় কয়েকঘন্টার জন্য মাকে দেখার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তার হাতে সম্ভবত হাতকড়া পড়ানো ছিল। একটাই ভয় একজন সাংবাদিককে? কেন রুপা কি কোন খুন করেছে?

ভোরের কাগজের মত একটি মুক্তচিন্তার পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। পত্রিকার মালিকানা আওয়ামীলীগের কোন নেতার হতেই পারে। কিন্তু পত্রিকাটিতে কি শুধু আওয়ামী গুণগান গাওয়া হতো? তা নিশ্চয়ই নয়।

ভিন্নমতের অনেক কিছুই প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে এখনও যতদূর জানি। সেই পত্রিকার সম্পাদক শ্রামল দত্ত কিন্তু আওয়ামী আমলে তৎকালীন সরকারের সমালেঅচনা করতে ছাড়েননি। এমনকি চরম সাম্প্রদায়িক সম্পাদক- ব্যক্তি মাহমুদুর রহমানের পক্ষেও দাড়িয়েছিলেন এই শ্যামল দত্ত।

আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে আওয়ামীলীগ আমলে নানা অভিযোগে আটক, হামলা করা হয়েছিল, পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তখন কিন্তু এই শ্যামল দত্তই এর প্রতিবাদ করেছিলেন।

তার সম্পাদিত পত্রিকা ভোরের কাগজে তিনি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে এর প্রতিবাদ করেছিলেন। আর সেই মাহমুদুর রহমানই শ্যামল দত্তের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে , পাশাপাশি যাতে জামিন না হয় সে জন্যও নানা চাপ অব্যাহত রেখেছে নানাভাবে।

২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সরকারি বার্তা সংস্থা বিএসএস থেকে আইয়ুব ভুঁইয়ার চাকরি চলে গিয়েছিল অন্য আরো সাংবাদিকের সাথে।

তখন পথে পথে ঘুরছিলেন বেকার আইয়ুব ভুইয়া। সেই আইয়ুব ভুঁইয়াকে ভোরের কাগজে চাকরি দিয়েছিলেন শ্যামল দত্ত চীফ রিপোর্টার হিসেবে। আর জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচনে ফরিদা ইয়াসমীন-শ্যামল দত্ত প্যানেল থেকে আইয়ুব ভুঁইয়া নির্বাচনে জিতেছেন।

কিন্তু চব্বিশের ৫ আগষ্টে রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টানোতে স্বরুপে দেখা দেন আইয়ুব ভুঁইয়া। নির্বাচিত ইয়াসমীন-শ্যামলকে প্রেসক্লাব থেকে বহিষ্কার করেন অত্যন্ত অন্যায়ভাবে।

শুধু তাই নয়, তার একসময়কার ভাতের যোগানদাতা শ্যামলের বিরুদ্ধে নানাভাবে কটুক্তি ও অপপ্রচারে নেমেছেন। এমনি শ্যামল দত্ত যাতে জামিন না পায় সেজন্য নানা লবিং করছেন। এই হলো মাহমুদুর রহমান ও আইয়ুব ভুঁইয়ার প্রতিদান !

শ্যামল দত্তের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ট এমন কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, শ্যামলের স্ত্রী তার ছোট কন্যা সন্তানকে নিয়ে অনেক বেকায়দায় ও প্রাণভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় বাস করছেন ঢাকায়। এক মেয়ে অস্ট্রেলিয়াতে রয়েছেন।

তিনি ইউনুসীয় ইন্টেরিম সরকারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের কাছে তার পিতার মুক্তির জন্য আবেদন করে যাচ্ছেন। কিন্তু কোন কিছুই কানে শুনছেন না ইউনুস সরকার।

যতদূর জানা গেছে, ইউনুস যখন লন্ডন গিয়েছিলেন তখন এসব সাংবাদিকদের মুক্তি/ জামিনের ব্যাপারে সেখানকার কয়েকটি সংগঠনেসর নেতারা ইউনুসের কাছে দাবি জানালে তিনি রাজী হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোন কথা রাখেননি।

ইউটিউবে বিভিন্ন রাজনৈতিক- সামাজিক বিষয় নিয়ে সোচ্চার ছিলেন সাংবাদিক মনজুর আলম পান্না। তিনি শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগহ আমলেও যেমন তাদের নানা কাজের অসংগতির সমালোচনা করেছেন তেমনি কথিত জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে ছিলেন।

কিন্তু সেই পান্নাও একসময়ে দেখলেন- এই ইউনুস সরকার ও তার জঙ্গী বাহিনী দেশে কি অন্যায় অপরাধ করছেন শাসনের নামে। তিনি আর বসে থাকেননি। তার ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে প্রতিবাদ করা শুরু করেছিলেন।

কিন্তু নাহ পান্নাকেও সহ্য করতে পারেননি এই মহামান্য নোবেলধারী ইউনুস সরকার। তাকেও জেলে পুরে দেয়া হলো।

* সাংবাদিক নির্যাতনে বিশ্বে বাংলাদেশ তৃতীয়।

সাংবাদিকদের কাজের জন্য বিপজ্জনক দেশের তালিকায় নাম এসেছে বাংলাদেশের। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এই তালিকায় নাম আছে পাকিস্তানেরও। তবে এ বছর সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়টি দেশের মধ্যে শীর্ষে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের নাম।

সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরেছে বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ)। সবচেয়ে বিপজ্জনক নয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে তৃতীয় অবস্থানে। আরএসএফের বার্ষিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্রমেই অবনতি হতে দেখা যাচ্ছে।

গত ৩রা মে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে আরএসএফ এর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫তম, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থান।

আগের বছর ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ছিল ১৬৩তম। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনায় সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের অধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংগঠন উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে গত তিন মাসে একাধিক বিবৃতি দেয়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে গত জুলাইয়ের মধ্যে দেশে ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সাত মাসে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে বাধা ও হামলায় আহত হয়েছেন ২৭৪ জন সাংবাদিক। সম্প্রতি টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনজন সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে হামলায় নিহত হয়েছেন।

*তারেক রহমানের বক্তব্যে প্রতিবাদে সালিম সামাদ।

সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান মানে বিএনপি’র “ হর্তাকর্তা বিধাতা” তারেক রহমান দাবি করেছেন- তাদের আমলে সাংবাদিকদের ওপর কোন অত্যাচার নির্যাতন হয়নি, স্বাধীন ছিল সংবাদমাধ্যম, ইত্যাদি ইত্যাদি।

তবে এর তীব্র প্রতিবাদ করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে কাজ করা প্রবীন সাংবাদিক সালিম সামাদ। তিনি তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেছেন- “ ঢাহা মিথ্যা কথা। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। বিনা দোষে, আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দ্রোহী মামলা দেওয়া হয়, নভেম্বর ২০০২।

হাওয়া ভবনের নির্দেশে পাঁচ দিন রিমান্ডে ডিজিএফএই নির্মম অত্যাচার। আমাকে খাওয়া/পানি দিতে অস্বীকার করে। আমি কোনো কাগজ সই করি নাই, তাই গোয়েন্দারা বলতে পারলো না, আমি স্বীকারোক্তি দিয়েছি। হাই কোর্ট দুইটা রায়ের পর ৫৫ দিন জেল জীবন শেষ হলো ।

২০০৪ আমাকে বাধ্য করে দেশ ছাড়তে। আমি ৬ বছর পর দেশে ফিরি আসি। তারপর দেশে আছি। RSF হিসাব অনুযায়ী (২০০১-২০০৫) সারা দেশ থেকে ৩০ সাংবাদিক জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছে। প্রায় ২০০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়েছিলো। বেশিরভাগ জিলা ও উপজিলা সাংবাদিক।”

*বিদেশেও উদ্বিগ্ন- ক্ষুব্ধ প্রবাসীরা
গত ২ জুলাই বিদেশে বসবাসকারি বাংলাদেশি ৮৮ জন সাংবাদিক, সাহিত্যিক , শিক্ষক গবেষক, সংস্কৃতি ও অধিকারকর্মী বাংলাদেশের সাংবাদিকদের অধিকার হরনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন।

তারা তাদের ওই বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা প্রবাসে বসবাস করলেও বরাবরের মতই দেশের ভালোমন্দ নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকি। সে কারণে দেশের অমঙ্গলের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি।”

কানাডার বাংলা পত্রিকা নতুন দেশ এর প্রধান সম্পাদক শওগাত আলী সাগরের স্বাক্ষরে এই বিবৃতি পাঠানো হয়।

বিবৃতিতে বলা হয়, “গত বছরের ৫ অগাস্টের পর থেকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের বিষয়টি প্রবাসী সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষক-গবেষক, সংস্কৃতি ও অধিকারকর্মীরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমেও মতপ্রকাশের নানারকম লিখিত ও অলিখিত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাকস্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে।

“যা আমাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জাজনক ও ঘৃণ্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। আমরা প্রবাসে বসবাস করলেও বরাবরের মতই দেশের ভালোমন্দ নিয়ে উৎকণ্ঠিত থাকি। সে কারণে দেশের অমঙ্গলের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি।”

বিবৃতিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে গত ১১ মাসে বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ‘সাংবাদিক নির্যাতন’ চলছে। এ সময় অন্তত ৪১২ জন সাংবাদিককে ‘হত্যাসহ হয়রানিমূলক নানা রকম মামলায়’ আসামি করা হয়েছে। ৩৯ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার, তিন শতাধিক সাংবাদিকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

সারাদেশে এক হাজারের সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতি, ১৬৮ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। সারাদেশের প্রেসক্লাবগুলো থেকে ১০১ জন সাংবাদিকের সদস্যপদ স্থগিত, বাতিল ও বহিষ্কার করা হয়েছে। এ সময় ‘মিডিয়া দখলের’ মত ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে।

“জুলাই-অগাস্ট আন্দোলন ও পরবর্তী সময়ে ১০ জন সাংবাদিক নিহত এবং অগণিত সাংবাদিক আহত হলেও সরকারের তরফ থেকে আক্রান্ত সাংবাদিক ও তাদের পরিবারের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়নি, বরং নির্যাতনের কালো হাতের সম্প্রসারণ ঘটেছে। পত্রিকা অফিসের সামনে মব সৃষ্টি করে ‘জেয়াফত’ করা হয়েছে, শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা বিশ্বেও সম্ভবত বিরল ঘটনা।”

তাই পরিশেষে বলতে চাই- এই হলো ইউনুসীয় শান্তির শাসন আর শান্তির অধিকার !

কথা বলার অধিকার! বাক স্বাধীনতার অধিকার! সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার অধিকার! ছি ইউনুস ছি! ছি মাহফুজ ছি!

## ইশরাত জাহান, লেখিকা, প্রাবন্ধিক ও নারী সংগঠক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *