বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাক্রমশালী ও কুচক্রী শিরোমনি হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা সময়ে নানা চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে দেশে দেশে।
তারা যে কোন দিক থেকে কি চক্রান্ত করে তা ঠিক বোঝা দায় হয়ে পড়ে তাদের সূক্ষ্ম কূটচালের ফলে। আর সে ফাঁদে পা দেয় অনেকেই।
যদিও মার্কিনীরা দাবি করে তারা জঙ্গীবাদের ব্যাপারে সবসময় জিরো টলারেন্স নীতিতে আছে। কিন্তু পৃথিবীর নানা জায়গাতেই বিশেষ করে এশিয়াতে তারাই ইসলামী জঙ্গীবাদের মদদ দিয়ে আসছে। তবে মজার বিষয় হলো তা কিন্তু কোন না কোনভাবে একটি সময়ে প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এরই মধ্যে গত সোমবার অর্থাৎ ১৩ অক্টোবর রাত থেকে রাজধানী ঢাকায় বারিধারায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে নজিরবিহীন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
মার্কিন দূতাবাস থেকে জঙ্গী হামলার আশঙ্কার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করার পর পরই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। ঘটনার তীব্রতা থেকে বোঝা যায়, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটসহ ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সোয়াট সদস্যদের দূতাবাসের নিরাপত্তায় নিয়োজিত হওয়া থেকে!
গুলশান বিভাগের ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সশরীরে উপস্থিত থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার তদারকি করেছে।
স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, মার্কিনীদের সাথে তো ইউনুস গং এর খুল্লাম খুল্লা সম্পর্ক। তাদের হাত ধরেই তো মেটিক্যুলাস ডিজাইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইউনুস ক্ষমতায় বসেছে।
ইউনুসও ক্ষমতা দখলের পর থেকেই নিষ্ঠার সাথে মণিবের ঋণ পরিশোধে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করে ইতিমধ্যে করেছে এনডিএ চুক্তি, চলছে মানবিক করিডর বাস্তবায়নের কাজ, বন্দর প্রাকৃতিক সম্পদ সবকিছুর সিদ্ধান্তই আসছে মার্কিনীদের তরফ থেকে। তাহলে হঠাৎ মার্কিন দূতাবাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ঘাটতি হলো কেন ?
রহস্যতো সেখানেই দানা বেঁধেছে। মার্কিনীরা যেমন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কাজ করে যাচ্ছে, একই সাথে সমানতালে কাজ করে যাচ্ছে ইসলামী মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী। কেননা জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠার এমন উপযুক্ত সময় বাংলাদেশে আগে কখনো আসেনি।
তাছাড়া ইউনুসকে ক্ষমতায় বসাতে তাদেরও রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা। যার পুরষ্কার হিসেবে গত চব্বিশের ৫ আগস্টের পর পরই জেল থেকে পালাতে দেয়া হয়েছে ( মূলত পালাতে দেয়ার নাটক করা হয়েছিল) শতাধিক জঙ্গীকে, মুক্তি পেয়েছে জসীমউদ্দিন রাহমানীর মতো মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জঙ্গীনেতা।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটনার অন্যতম মূল চরিত্র আরেকজন। সে হলো মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আরেক শীর্ষ জঙ্গী নেতা বরখাস্ত সামরিক কর্মকর্তা মেজর জিয়া। জঙ্গী সংগঠন আল কায়েদার বাংলাদেশ লিড, আনসার আল ইসলাম (আনসারুল্লাহ বাংলা টীমের) প্রধান মেজর জিয়া ।
এই জিয়া মুক্তচিন্তা-মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবাদী লেখক অভিজিৎ রায়, জাগৃতি প্রকাশনীর ফয়সাল আরেফিন দীপন এবং কলাবাগানে সংঘটিত জুলহাস-তনয় খুনের মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি। এছাড়াও আরো একাধিক মামলায় তার বিরুদ্ধে বিচার চলমান রয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে তার বিষয়ে তথ্য চেয়ে ৫০ হাজার ডলারের পুরষ্কারও ঘোষিত হয়েছিল। ২০১১ সালে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর থেকেই পলাতক ছিল মেজর জিয়া। ইউনুস গং এর ক্ষমতা দখলের পর নির্বিঘ্নে ও সদম্ভে প্রকাশ্যে এসেছে সেই ভয়ংকর মেজর জিয়াও!
শুধু কি প্রকাশ্যে আসা? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ এর ২৯ ডিসেম্বর আইনজীবীর মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়ে নিজের মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করে মেজর জিয়া। পাশাপাশি মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্ট থেকে নাম কাটানোর জন্য আবেদন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

এসবের পাশাপাশি সে মুক্ত পরিবেশে নিঃশঙ্কচিত্তে বেসরকারি টিভি চ্যানেল-২৪ এর কাছে সাক্ষাৎকারও দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমানতালে অসম্ভব সক্রিয় এই জঙ্গী জিয়া।
খুব নিরাপদে ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের আশ্রয় প্রশ্রয়েই রয়েছে এই জঙ্গী মেজর জিয়া। শুধু তাই নয় অত্যন্ত সক্রিয় সে তার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে। নানা সূত্রে যতটুকু জানা গেছে, মেজর জিয়া বর্তমানে থাকে রাজধানী ঢাকায় আর্মি গলফ ক্লাবের কাছে বনানী ডিওএইচএস এর ৩ নম্বর বিল্ডিংয়ে।
সেনা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার প্রমাণিত অভিযোগে চাকুরিচ্যুত, এবং দেশে জঙ্গীবাদ বিস্তারের অন্যতম হোতা মেজর জিয়া সেনা এলাকাতেই থাকছে আরামসে। শুধু তাই নয়, তার নিত্য আসা-যাওয়ার জায়গা হলো গুলশান এভিনিউয়ের ৯৬ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কথিত গুম কমিশনের অফিস।
গুম কমিশনের চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম চৌধুরি মেজর জিয়ার মামা এবং সংগঠনটির মূল গবেষক নাবিলা ইদ্রিস তার কাজিন। সেখানে তাকে আরো সঙ্গ দেয় গুম কমিশনের সদস্য ও অধিকারের সাবেক কর্মী সাজ্জাদ এবং আমার দেশের সাংবাদিক আবু সুফিয়ান টিপু।
হিসাব মেলাতে হয়তো অনেকেরই হিমশিম খেতে হবে এক্ষেত্রে। কারণ নানা কায়েমি স্বার্থ কাজ করে ক্ষমতার ক্ষেত্রে। কারণ বৈশ্বিক রাজনীতির বাইরেতো নয় এই ক্ষুদ্র বাংলাদেশটি।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এর ওপর নজর পড়েছে বার বার বিভিন্ন বহিঃশত্রুর। আর মার্কিনীদের একবার কু দৃষ্টি পড়লে তা থেকে রেহাই নেই। এটিই নির্মম বাস্তবতা। ফলে উনিশশো একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিনীরা পারেনি বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়া ঠেকাতে।
তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ও বিশ্বের মুক্তিকামী গনতান্ত্রিক দেশের জনগণের তীব্র সমর্থন ছিল।
তার একটি প্রতিশোধ নিয়েছে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে। এরপরও নানাভাবে চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যাটে-বলে মেলেনি বলে পারেনি। কিন্তু ২০২৪ এ এসে মার্কিনীদের সেই ডিপ ষ্টেট ষড়যন্ত্র কাজে লেগে যায়। শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ থেকে সরানোই ছিল মার্কিনীদের মূল লক্ষ্য।

কারণ শেখ হাসিনা থাকলে বাংলাদেশকে তার আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারছিলনা আমেরিকা। সেজন্য তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়ার সব বন্দোবস্তই করে রেখেছিল মার্কিনীরা।
কিন্তু সেখানে বাঁধ সাধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত। অত্যন্ত কৌশলে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর মাধ্যমেই শেখ হাসিনাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। রক্ষা পায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জীবন।
নাহলে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট যে মর্মান্তিক-নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছিল হয়তো তার মাত্র ৪৯ বছরের মাথায় হয়তো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকেও জীবন দিতে হতো।

শেখ হাসিনার আমলেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই জঙ্গী মেজর জিয়ার অনেক তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। ফলে তার চাকরিও চলে যায়।
এই জঙ্গী মেজর জিয়াকে দিয়েই বাংলাদেশে আল কায়েদার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশে আল কায়েদার মূল কন্টাক্ট মেজর জিয়া এখন দেশে ইসলামি রিপাবলিকের নামে স্থায়ী জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে।
সাথে আছে আরেক কুখ্যাত সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্ণেল হাসিন ও ব্রিগেডিয়ার হাসান নাসির। তাদের মাথার উপরে আছে আইএসআই আশীর্বাদপুষ্ট লে: জেনারেল কামরুল হাসান ও লে: জেনারেল ফয়জুর, আছে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের পুত্র সাবেক সেনাকর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আজমি।
রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করার পর এখন তাদের টার্গেট সেনাবাহিনী। ইরানের রেভ্যুলেশনারী গার্ডের আলোকে সেনাবাহিনীর ইসলামী উগ্রপন্থীদের সামনে এনে ইসলামিক রেজিস্ট্যান্স আর্মি বানানোই তাদের লক্ষ্য।
এই নীলনকশার অংশ হিসেবেই ২৪ সেনাকর্মকর্তার নামে আইসিটিতে (মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং ১৫ জনকে সেনা হেফাজতে নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল আরো ১৫০ সেনাকর্মকর্তার নামেও অভিযোগ নামা তৈরি করেছে গুম কমিশন। এই কাজে গুম কমিশনের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, তাদের মিড লেভেলের দুইজন কর্মকর্তা চলতি বছরের আগষ্টে বাংলাদেশে এসেছিলো এই কাজে।
সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি ও নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়ার প্রেক্ষিতে বাহিনীতে যখন চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে ঠিক তখনই মরণ কামড় হিসেবে মার্কিন দূতাবাসে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করেছিলো মেজর জিয়া গং।
কেননা দুনিয়াজুড়ে জঙ্গীবাদ বিস্তারের সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতিই হলো সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটিয়ে আলোচনায় আসা। এটা করতে পারলে এই ঘটনার রেশ ধরে সামরিক ক্যু থেকে শুরু করে অন্যসব কিছুই দখল করা সহজ হবে- এমন পরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছিল এই জঙ্গী জিয়া গোষ্ঠীর কাজ।
এসব কিছু মিলিয়ে এখন অপেক্ষার পালা- এই বিষয়ে মার্কিনীদের প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম- দুধকলা দিয়ে পোষা সাপ এখন নিজের দিকেই ফণা তুলে বসেছে যেন। ইতিহাসেও এর নজির আছে ভুঁড়ি ভুঁড়ি।
এ কথাতো আর গোপন নেই যে, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদেরকে আফগানিস্তান থেকে হটানোর জন্য সম্পূর্ণ মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতাতেই আল কায়েদা গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এরপর চরম উগ্রবাদী ইসলামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সেই আল কায়েদাই এক সময় আক্রমণ করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে টুইন টাওয়ার আর পেন্টাগনে।
শুধু কি তাই? সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়ার পর মার্কিনীরা সেখানে তাদের ঘাঁটি গাড়ে। লাদেনকেও হত্যা করে মার্কিন বাহিনী। কিন্তু তাতে কি আল কায়েদা শেষ হয়ে যায় ? তা হয়নি। সেই চরম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীই এখন আফগানিস্তানের ক্ষমতায়।
অতি সম্প্রতি সিরিয়ার বাশার আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রপতি হওয়া আহমেদ আল শারাও ছিলো আল কায়েদা নেতা। তিনিও ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ান্টেড তালিকাতেও। কিন্তু মোষ্ট ওয়ান্টেড হলে কি হবে? সেই আল শারাই কিছুদিন আগে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়ে এসেছেন।
তাই চলমান এই ঘটনাপ্রবাহে মার্কিনীদের ভূমিকা পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও নাটকের প্লট এবং চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। তবে সকল কিছুর ফলাফল একটাই। বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করা। আর এদেশে ইসলামী জঙ্গীবাদের প্রতিষ্ঠা করা।
ইসলামী জঙ্গীবাদ প্রতিষ্ঠা পেলে সেই জঙ্গীবাদ দমনে তখন মার্কিনীদের পক্ষে বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে অনেক সুবিধে হবে। দেখা যাক কোথাকার পানি কোথায় গড়ায় ।
#নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, প্রাবন্ধিক।
