দেশের ৪টি বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখন পুরোটাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতকদের দল জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণে।

রীতিমতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মধ্য দিয়েই তারা এই দখল পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য নানা কৌশল ও ষড়যন্ত্র ছিলই। কিন্তু আইনগতভাবেতো তারা তা জায়েজ করে নিয়েছে।

জামাতের দখলে মানে তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের দখলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালরের ডাকসু, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জাকসু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাকসু এবং এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর প্রায় সবটাই শিবিরের নিয়ন্ত্রণে এখন।

যেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের পূর্বসূরী হলো একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যার দল আলবদর বাহিনী। এই আলবদর বাহিনী হলো তৎকালীন পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাকর্মী অর্থাৎ ক্যাডাররা।

এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও আবাসিক হলগুলোর নিয়ন্ত্রন নেয়ার পর জামায়াতের মনোবল আরেক দফা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য জামায়াতের অনেক আগে থেকেই কুচক্রী পরিকল্পনা ছিল।

বিএনপি মনে করেছিল তারাতো দেশের সবচেয়ে বড় দল ( আওয়ামীলীগের অনুপস্থিতিতে)। সুতরাং তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলই জিতে আসবে।

আবার গত ২০২৪ এর কথিত জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের রাজনৈতিক দল এনসিপিও মনে করেছিল তারাও বেশ কিছু জিতবে। কিন্তু সবাইকে ল্যাঙ মেরে দিয়েছে জামায়াত-শিবির।

এর মধ্যে গত ১৭ অক্টোবর মহা ধুমধামে জাতীয় সংসদ ভবন চত্বরে উড়ে এসে জুড়ে বসা মেটিকুলাই ডিজাইনার ড. মুহাম্মদ ইউনুস কথিত ‘ জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছে বেশ কয়েকটি দল থেকে।

বিএনপি-জামায়াতসহ ২৫ টি দল সই করেছে এতে। তবে কিংস পার্টি এনসিপি সই করেনি তাদের কিছু দাবি দাওয়া পুরন হয়নি এ অভিযোগে। গোস্বা করে সেদিন তারা কথিত জুলাই যোদ্ধাদেরকে লেলিয়ে দিয়ে নাটক করেছে।

এ নিয়ে সনদে সই করা দলগুলো এনসিপি’র সমালোচনা করছে। এনসিপি’র নেতাদের অভিযোগ তাদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে এই ‘ জুলাই সনদ’ নিয়ে।

বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমদসহ বিএনপি সঙ্গে এনসিপির তো একপ্রকার পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ চলছে এ নিয়ে । এই জুলাই সনদ নিয়ে জামায়াত প্রথমদিকে কিছু সমালোচনা করলেও তারা কিন্তু সেদিন কথিত সেই সনদে স্বাক্ষর করে ফেলেছে।

যদিও গত চব্বিশের কথিত জুলাই আন্দোলনে জামায়াত শিবির কিন্তু তখনকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে লুকিয়ে থেকে সব ধরনের নাশকতা ঘটিয়েছে।

জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তখন থেকে গলায় গলায় ভাব এই এনসিপির। কিন্তু জামায়াত যখন দেখলো যে যদি নির্বাচন হয়ই আগামী ফেব্রুয়ারিতে তাহলে তারা আর পেছনে পড়ে থাকবে কেন ?

তারাও তাদের আগে থেকে নির্ধারিত কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করে নিলো। কারণ এক ঢিলে তারা শুধু দুই পাখি নয় অনেক পাখিই শিকার করতে চায়।

একদিকে ইউনুস সরকারের মধ্যেও থাকলো আবার বিএনপিকেও বুঝিয়ে দিলো যে আমরাও কিন্তু আছি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, যদি তা সত্যিই অনুষ্ঠিত হয়। অপরদিকে এনসিপিকে বুঝিয়ে দিলো- আমরা ছাড়া তোমাদেরকে তেমন আর কেউ গনবেনা, কারণ আমরাইতো তোমাদেরকে সবকিছু দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। না হলে তোমরা কাঁচকলা করতে পারতে।

জামায়াতও জাতীয় সংসদে পি আর পদ্ধতি ( সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব) দাবি করে আসছে। কিন্তু তাই বলেতো আর নির্বাচনী ট্রেন ফেল করা যাবেনা , এই পিআর পদ্ধতি নিয়ে গোঁ ধরে থেকে। এ ভাবনা থেকে জামায়াত সব পথই খোলা রেখেছে। যেদিকে সুবিধে হয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব সেদিকেই ঝুঁকবে জামায়াত।

আর এতেই খেপেছে এনসিপি। জঙ্গী টোকাই ও কিংস পার্টি এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করে বলেছেন, পিআর নিয়ে জামায়াতের আন্দোলন রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

তিনি বলেছেন, ‘আমরা কিছু মৌলিক সংস্কার এবং বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদের আইনি কাঠামো তৈরি করার জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু জামায়াত এবং তার সহযোগীরা এটা ছিনতাই করেছে, তারা একে একটি কাঠামোগত পিআর বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে এবং এটাকে তাদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য দর–কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।’

তবে যেই জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান এনসিপি’র নেতাদের দেখলে জড়িয়ে ধরতেন কিছুদিন আগেও তাদের সমালোচনা করতে ছাড়ছেনা এখন জামায়াত।

এনসিপি’র নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের জবাবে জামায়াতে ইসলামীও কম যায়না। তারাও পাল্টা সমালোচনা করে বলেছে- নাহিদ ইসলামের কাছ থেকে এ ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের প্রধান এহসানুল মাহবুব (জুবায়ের) গত ১৯ অক্টেবর এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক স্ট্যাটাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম দাবি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির সমালোচনা করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর।

তার বক্তব্য সর্বৈব মিথ্যা ও দুঃখজনক। তার কাছে এই ধরনের বালখিল্য বক্তব্য জাতি আশা করে না।

জুলাই জাতীয় সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবিতে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়

এবং রাজপথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তার দৃঢ় অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। কাজেই নাহিদ ইসলামের বক্তব্যের যৌক্তিক কোনো ভিত্তি নেই।’

যতদূর জানা গেছে, বিএনপি যেমন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ( যদি অনুষ্ঠিত হয়) ক্ষমতায় যেতে উদগ্রীব হয়ে আছে। ড. ইউনুস এখন বিএনপিকে যা বলবে তাই করবে। তাই জামায়াতও এই সুযোগে বিএনপি’র সাথে অনেকটা তাল মিলিয়ে ২০০১ সালের নির্বাচনের মত দরকষাকষি করে বেশ কিছু আসন ভাগিয়ে নিতে চায়।

কারণ তারাও জানে যে যতই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে জিতুক না কেন জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি ভিন্ন। তাই এই সুযোগে বিএনপিকে চাপে ফেলে আসন সংখ্যা ও সরকার গঠন করলে সেখানেও বড় ধরনের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে নিয়েছে।

বিএনপি ও জামায়াতের আসন ভাগাভাগি, ক্ষমতার ভাগাভাগির বিষয়টি টের পেয়ে টোকাইদের জঙ্গী সংগঠন এনসিপিও সুযোগ বুঝে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী উভয়কে বাক্যবাণে সমালোচনা করে নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নিতে চাইছে।

কারণ তাদের ওপর থেকে মেটিকুলাস ডিজাইনার ও পাকা খেরৈায়ার ড. ইউনুস ও তার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘ স্নেহ-ভালোবাসা’ সরিয়ে নেয় তাহলে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হবে। আর তখন কে কোনপথে পালাবে এই কথিত জুলাই অভ্যুত্থানের নেতারা তার ঠিক থাকবেনা। তাই তারাও নিজেদের অবস্থান তৈরী করে নিতে নানা কথা শুরু করেছে।

অবশ্য এই বিরোধ যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আখেরে লাভ হবে আওয়ামীলীগের, যদিও তারা এখন দেশে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারছেনা। কিন্তু এই তিন দলের গুতোগুতিতে সাধারন জনগনের আস্থা উঠে যাবে।

এবং এখনই বলতে শুরু করেছে চব্বিশের কথিত জুলাই আন্দোলনের সমর্থিততরা। তাই এখন বলতে শুরু করেছে যা করেছি, ভুল করেছি, প্রতারিত হয়েছি। এর চেয়ে আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনাই ভালো ছিল।

এমনিতেই জামায়াত-এনসিপি’র প্রতি এদেশের মানুষের আস্থা যে খুব বেশি আছে তা কিন্তু নয়। জামায়াতকেতো একাত্তরের ঘাতক রাজাকার- আলবদরের দল হিসেবে চেনে।

আর এনসিপি বা কথিত বৈষম্যবিরোধীদের ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক বললে এখনতো মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে। কারণ সমন্বয়কের নাম দিয়ে এবং এখন এনসিপির নামে নানাভাবে চাঁদাবাজি, টেন্ডার হাতিয়ে নেয়া, বড় বড় প্রকল্প থেকে বড় অংকের পার্সেন্টিজ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে এনসিপি নেতাদের মুল কাজ।

# রাকীব হুসেইন, লেখক, প্রাবন্ধিক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *