পৃথিবীর কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ আজও গণ-অভ্যুত্থানের পর সত্যিকারের পুনর্জাগরণ ঘটাতে পারেনি। ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে—স্বপ্নে ভাসা সেই অভ্যুত্থান শেষমেশ রক্ত, ধ্বংস আর বিভাজনের স্রোতে ভেসে গেছে।
মিসর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন—সবখানেই মানুষ রাস্তায় নেমেছিল মুক্তির আশায়।
কিন্তু ফিরে পেয়েছে শূন্যতা, হিংসা, গৃহযুদ্ধ আর পরাধীনতার নতুন রূপ। নেতৃত্বের নামে এসেছে উগ্রতা, আবার কখনো এসেছে বিদেশি হস্তক্ষেপ।
বলতে হয়, এটা যেন মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য এক জন্মগত রাজনৈতিক দুঃস্বপ্ন—যা বারবার ফিরে আসে। এবার বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।
এই দুঃস্বপ্ন থেকে আলাদা একটি উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কা।
২০২২ সালে সে দেশে ভয়াবহ এক গণ-অভ্যুত্থানের পর পতন ঘটে রাজাপাকসে পরিবারের। তখনকার শ্রীলঙ্কা ছিল বাংলাদেশের তুলনায়ও বেশি বিপর্যস্ত—দেউলিয়া অর্থনীতি, খালি কোষাগার, চরম মূল্যস্ফীতি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংকট—সবকিছু একসাথে।
কিন্তু সেই সংকটের মুহূর্তে শ্রীলঙ্কা সিদ্ধান্ত নেয় দেশকে আগে বাঁচাতে হবে। রাজনীতিকে নয়, দেশকে প্রাধান্য দিতে হবে।
তখন গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তী সরকার—যারা বিলাসিতা পরিহার করে, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধ করে, সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন পর্যন্ত সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয়। তারা মিডিয়ায় প্রচারের বদলে নীরবে দেশ গড়ার কাজে নেমে পড়ে।
শুধু তাই নয়—আন্দোলনের তরুণরাও দায়িত্ব নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যায়। ফলে কোনো মব জাস্টিস হয়নি, কেউ সরকারি অফিসে আগুন দেয়নি, কেউ আদালত নিজের হাতে তুলে নেয়নি।
আর এখন? সেই শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতি কমেছে, আন্তর্জাতিক আস্থা ফিরেছে, প্রশাসনে এসেছে স্বচ্ছতা।
শ্রীলঙ্কা একা নয়। জর্জিয়া—একটি খ্রিষ্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, ২০০৩ সালে ‘রোজ রেভল্যুশন’-এর মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠন করে।
তারা শুধু নেতৃত্ব বদলায়নি। তারা সংবিধান, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা—সবকিছু সংস্কার করেছে। আজ তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের দোরগোড়ায়।
এই দুটি দেশ প্রমাণ করেছে—গণ-অভ্যুত্থান নিজে কিছু নয়। সেটা কেবল একটি সুযোগ। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে দরকার হয় আত্মশুদ্ধি, যোগ্য নেতৃত্ব ও সততা।
এই গুণগুলো মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে দুঃখজনকভাবে প্রায় অনুপস্থিত বলা যায়। পরিবর্তে ঘোর মৌলবাদ জন্ম নেয় যা উন্নয়নের পক্ষে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ সেই ব্যতিক্রম হতে পারত। কিন্তু পারে নি।
মানুষ চেয়েছিল একটি দায়িত্বশীল, সৎ ও বৈষম্যহীন সরকার। কিন্তু বাস্তবে এসেছে দুর্নীতি, বিলাসিতা, চাঁদাবাজি আর হিংসার লাইসেন্স।
বাংলাদেশ চেয়েছিল শ্রীলঙ্কার মতো একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যারা দেশ গড়বে।
কিন্তু পেয়েছে এমন একটি শাসনব্যবস্থা—যা নামেমাত্র অসাম্প্রদায়িক হলেও ভেতরে ভেতরে একটি ইসলামিক রাষ্ট্রের কাঠামো পায়ে মাটি খুঁজছে। যে সরকারে অমুসলিমদের কোনো সম্মান নেই, সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকে।
এই নয় মাসে—কত হিন্দু নির্যাতিত হয়েছে, কত আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কতজন প্রাণ হারিয়েছে—তার কোনো হিসাব নেই। মিডিয়া নীরব, প্রশাসন নিষ্ক্রিয়। যেন সবকিছু চলছে এক অদৃশ্য সম্মতিতে।
এখানে একটি নির্মম সত্য বলতেই হয়—বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। কারণ এই দেশের গণমাধ্যম আজ পাকিস্তানের প্রেমে পড়ে গেছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে, বাংলাদেশের অধিকাংশ মিডিয়া এমনভাবে প্রতিবেদন করে যেন পাকিস্তানই জিতেছে, ভারত হেরেছে। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
পাকিস্তান এখন এশিয়ার অন্যতম সন্ত্রাসবাদে ভরা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। যাকে বিশ্ব দরবারে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমন একটি দেশকে যারা আদর্শ ভাবে, তারা নিজেদের উন্নতির পথ খুঁজে পাবে কীভাবে?
শ্রীলঙ্কা পেরেছে। জর্জিয়াও পেরেছে।
বাংলাদেশ পারবে কি না—তা নির্ভর করে এই প্রশ্নের উত্তরেই: গণ-অভ্যুত্থান হবে আত্মশুদ্ধির পথে, নাকি পুরনো অন্ধত্বের পিঠে চড়ে আরও একটি বিপর্যয়?
এটা শুধু প্রশ্ন নয়, এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের মোড় ঘোরানোর একটি চূড়ান্ত সতর্কবাণী। এখনো সময় আছে—কিন্তু সেটা খুব বেশি নয়।
হয়তো শিঘ্রই বাংলাদেশে একটি রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে । আকাশে কালো মেঘ জমে গেছে ।
#পূর্ণ লাল চাকমা