নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা করেনি এখনও নির্বাচন কমিশন। কবে নির্বাচন হবে, কবে মনোনয়নপত্র দেবে, জমা নেবে, বাছাই হবে, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার কবে, কবে প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত বাছাই শেষে প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করা হবে ইত্যাদি কিছুই ঘোষণা হয়নি।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ঘোষণা করা হচ্ছে বার বার অবৈধ ইন্টেরিম সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের পক্ষ থেকে।
সে অনুযায়ী দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রার্থী ঠিক করাসহ নির্বাচনের অন্যান্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে।
কিন্তু নির্বাচনী তফশীল ঘোষণার আগেই গত ৩ নভেম্বর সোমবার দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩৭ আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। কোন আসনে বিএনপির মনোনয়ন কে পাচ্ছেন সে ঘোষণাই দিলো তারা।

অবশ্য জাতীয় সংসদে ৩০০ টি আসন হলেও বাকী ৬৩ টি আসনে এখনো তাদের কোন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেনি দলটি । এসব আসনে কি বিএনপি তাদের জোটের শরিকদের জন্য রেখেছে , নাকি পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরে ঘোষণা করবে এসব আসনে তাও স্পষ্ট করেনি।
তবে জামায়াতে ইসলামী, টোকাই জঙ্গীদের দল এনসিপি ও আরো কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে এই ৬৩ টি আসন ভাগাভাগিও করতে হতে পারে বিএনপিকে-এমনটাই জানিয়েছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা।
রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, বিএনপির গুরুতর অসুস্থ চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ফেনী–০১, বগুড়া–০৭ ও দিনাজপুর–০৩ আসন থেকে প্রার্থী হচ্ছেন। আর এখনো লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে জানানো হয়েছে।
নভেম্বরের শেষদিকেই তিনি দেশে ফিরবেন বলে দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তবে গত ৩ নভেম্বর বিএনপি’র মনোনয়ন ঘোষণার পর মনোনয়ন বঞ্চিতদের ইশারা ও ইন্ধনে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-রেল পথে আগুন, গাড়ি ভাংচুর, বোমাবাজি, সড়ক অবরোধসহ নানা ধরনের নাশকতা ঘটিয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড, ফরিদপুর, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হিংসাত্মক-নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের প্রকৃত চরিত্রের প্রমাণ দিচ্ছে দলটি। আর নির্বাচন যদিও বা হয় তাহলে সেক্ষেত্রেও যে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হবেনা তার কোন গ্যারান্টি নেই।
ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণাসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত-নিরাপদে চলাফেরার জন্য বিএনপি বুলেটপ্রুফ কয়েকটি গাড়ি কেনার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে। সেইসাথে বেগম জিয়া ও তারেক রহমানের জন্য অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্যও আবেদন করে রেখেছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো ২০০৭ সালের এক এগারোর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেনাবাহিনীর হাতে আটক ও প্রচন্ড নির্যাতনের শিকার হওয়া তারেক রহমান সত্যিই কি সেনাবাহিনীকে ম্যানেজ করতে পেরেছেন তার দেশে ফেরা নিয়ে ?
কারণ ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে তারেক জিয়ার দুর্ব্যবহার ও সেনা অফিসারদের প্রতি নানা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিন্তু সেনা সদস্যরা ভুলে যাননি। যার ফলে ২০০৭ সালে তারেককে গ্রেপ্তারের পর সেনা নির্যাতনে তার মেরুদন্ডও ভেঙ্গে গিয়েছিল।
এমনকি ২০০৮ সালে কারাগার থেকে মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়ে তখন লন্ডন পালিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই থেকে তারেক লন্ডনে পালালেন এবং সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন এখনো। যতই খালেদা জিয়া সাবেক সেনাপ্রধানের স্ত্রী ও তারেক রহমান সেনাপ্রধানের পুত্র হিসেবে সেনা পরিবারের অত্যন্ত আপনজন দাবি করেন না কেন তখনকার আর্মি অফিসাররা তা ভুলে যাননি নিশ্চয়েই।
অবশ্য একাত্তরের ঘাতক- রাজাকার- আলবদর ও গণহত্যাকারি দল হিসেবে কুখ্যাত জামায়াতে ইসলামীও ৩০০ আসনেই তাদের প্রার্থীদের তালিকা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে। নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আসনভিত্তিক তৎপরতাও শুরু করে দিয়েছে তারা।
মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী এ দলটি এবার নুতন ও তরুণদের মধ্য থেকে প্রায় ৮০ ভাগ প্রার্থী ঘোষণা করেছে, যারা আগে নির্বাচন করেনি।
আর অতীতে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন প্রার্থী রয়েছেন ৫৯ জন। অতীতে জামায়াতে প্রবীণ নেতৃত্বের আধিপত্য ছিল। কিন্তু এবার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী তরুণ নেতৃত্ব সামনে আনার চেষ্টা করছে দলটি।
তবে দলটি আরো কিছু ইসলামপন্থী দলের সঙ্গে নির্বাচনী জোটও গঠন করে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে পারে, যদি বিএনপি’র সঙ্গে তাদের ঠিকমতো সমঝোতা না হয় আসন ভাগাভাগি নিয়ে।
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে জঙ্গী টোকাইদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এর মধ্যে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলমসহ আরো বেশ কয়েকজনের নামের তালিকা রয়েছে।

৩ নভেম্বর সোমবার রাতে এনসিপির সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। তবে চূড়ান্ত তালিকা শিগগিরই আনিুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছেন দলটির প্রথম সারির নেতারা।
**নির্বাচন আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন ও সন্দেহ রয়েছে।
কারণ গত কয়েকদিন ধরে কথিত জুলাই সনদ, গণভোট, ঐক্যমত্য কমিশিন, ইন্টেরিম সরকারের প্রতারণা, জুলাই সনদ স্বাক্ষরে নোট অব ডিসেন্ট, নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে চরম বিষোদ্গার করে বেড়াচ্ছে।
কেউ বলছেন- নির্বাচন বানচাল করতেই এসব করা হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো- গত দেড় বছরে এই ইউনুসীয় সরকারের যেসব দেশবিরোধী অপরাধযজ্ঞ করেছে সেসবের আদৌ বিচার হবে, নাকি তারা ইনডেমনিটি নিয়ে রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা চাইবেন ? অথবা কোন কিছু ছাড়াই সেফ এক্সিট পেয়ে যাবেন ?
মেটিকুলাস ডিজাইনের মূল খলনায়ক নোবেল লরিয়েট ইউনুস সাহেব ও তার করিৎকর্মা সাঙ্গোপাঙ্গোরা কোন ধরনের ইনডেমনিটি ও সেফ এক্সিট ছাড়া এমনি এমনি একটি নির্বাচন দিয়ে সহিসালামতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবেন।
আর ওই যে ‘ দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী’র পালের গোদাদের কি হবে ? সুতরাং যত সহজেই ভাবা হোক না কেন যে একটি নির্বাচন হলেই দেশে গণতন্ত্র ও শান্তিতে দুধের নহর বইবে তা ভেবে আত্মতুষ্টিতে আত্মহারা হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা আপাতত।
ওই যে গত ১৭ অক্টোবর ‘ ঝুলাই সনদ’ নামে একটি কাবিননামায় স্বাক্ষর করেছে দেশের ২৫ টি রাজনৈতিক দল সেটিকে তো এই ইন্টেরিম সরকার সংবিধানের বিকল্পই ভাবতে শুরু করে দিয়েছে। এই কথিত জুলাই সনদ বা ঝুলাই সনদ যে নামেই তাকে ডাকা হোকনা কেন এটিকে পাশ করানো হবে যেকোন ভাবেই।

আর কথিত গণভোট এর মধ্য দিয়ে এর বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করা হবে সর্বোচ্চভাবে। যাতে করে নির্বাচিত সরকার আসার পরেও গত ৫ আগষ্টের পর থেকে অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতা থাকাকালে তাদের কৃতকর্মের কোন বিচার করা না যায়।
আর তা করতে না পারলে সনদের বৈধতা-অবৈধতা, গনভোট, সেনা অফিসারদের বিচার প্রক্রিয়া, সেনা অভ্যন্তরে অসন্তোষ, ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে এমন এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হবে যাতে করে নির্বাচনী প্রক্রিয়াই নস্যাৎ হয়ে যাবে।
এমন পরিস্থিতিও সৃষ্টি করা হতে পারে যে, মেটিকুলাস ষড়যন্ত্রের মূল কারিগর ড. ইউনুসের অধীনে একটি জাতীয় সরকার গঠনের জন্য সব রাজনৈতিক দল তাকেই তোষামোদিতে ব্যস্ত থাকবে।
সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে এর বৈধতাও দেয়া হতে পারে। কারণ এই ইউনুস কখন যে কোন ফন্দি আঁটবে তার কোন ঠিক নেই।
কিন্তু এর মধ্যে আওয়ামীলীগ যদি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মত দেশপ্রেমিক জনতার আস্থায় ( যারা ইতিমধ্যে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছে ইউনুসীয় যাঁতাকলে) নিয়ে সারাদেশে এই জঙ্গী ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয় তখন হয়তো ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
এজন্য অবশ্য আওয়ামীলীগসহ সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও দাতা দেশগুলোর প্রভাব কাজে লাগানো গেলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। তা নাহলে অতি সম্প্রতি পাকিস্তান-বাংলাদেশ ও তুরষ্কের মধ্যে যে সামরিক ভাতৃত্ব সহায়তার ষড়যন্ত্র চলছে তা আরো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ইসলামী জঙ্গীবাদ আরো বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার আশংকা থেকেই যায়।
এমনটি হলে তা এক ভয়াবহ সুনামি বয়ে যাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। এই ইসলামী জঙ্গী সামরিক সুনামি থেকে রক্ষা পেতে হলে বাংলাদেশের জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন পথে নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে চাইছেন।
# ইশরাত জাহান, লেখিকা, প্রাবন্ধিক ও নারী সংগঠক।
