একটা সময়ে কোথায় খুব বেশি অরাজকতা, সন্ত্রাসী রাজত্ব কায়েম হলে আমরা বলতাম কি হলো দেশটার- মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি ?

আর এখন গত ১১ মাস ধরে বাংলাদেশটা হয়ে গেল ‘ মব এর মুল্লুক’। আর সেই মব মুল্লুকে রাজত্ব করছেন শান্তিতে নোবেল লরিয়েট মুহম্মদ ইউনুস।

তিনিই এখন হর্তা- কর্তা- বিধাতা বনে গেছেন। সেই মার্কিন ইউএসএআইডি’ র আর্থিক সহায়তায় তাদের সেই ‘ডীপস্টেট’ এর ক্রীড়ানক হয়ে ইউনুস বাহিনী এখন বাংলাদেশে মূর্তিমান আতংকের নাম।

ইউনুস বাহিনীর বয়ানে আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনা শুধু স্বৈরাচারই নয় ফ্যাসিবাদ। কিন্তু দেশবাসীর ঘাড়ে সেই ফ্যাসিবাদের ( ইউনুস গং কথিত) পরিবর্তে আরও ভয়ংকর ‘ মবের মুল্লুক’ চেপে বসেছে।

এই জুলাই- আগষ্টে কি আরও খারাপ কিছু অপেক্ষা করছে এ দেশবাসীর জন্য? বড় ধরনের কোন গৃহযুদ্ধের দিকে এগুচ্ছে নাতো দেশ- এমন আশংকা- আতংক বিরাজ করছে এখন এই সমাজে।

মার্কিন মুল্লুকে ডেমোক্রেট দলীয় জো বাইডেন সরকারের আমলে এই ডীপষ্টেট ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে যা বর্তমান রিপাবলিকান দলীয় সরকার প্রধান ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে বলেছেন।

তিনি নিজেই বলেছেন ইউএসএআইডি’ র মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার ঢালা হয়েছে বাংলাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে সরকার পতনের জন্য।

অর্থাৎ দেশি-বিদেশী আন্তর্জাতিক চক্র এর পেছনে কাজ করেছে। অনেকেই আশা করেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে তিনি মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবেন।

কিন্তু মার্কিনীরা নিজেদের স্বার্থের বাইরে কখনো কিছু করেছে এমন কোন উদাহরন নেই।বাংলাদেশ নিয়ে নয়া খেলায় মেতেছে এখন ট্রাম্প প্রশাসন।

চট্টগ্রাম বন্দর চাই তার, বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইনে ঢোকার জন্য ‘ মানবিক করিডোর’ চাই।

সবচেয়ে যেটি বড় প্রয়োজন তা হলো মার্কিন আজ্ঞাবহ একটি সরকার তা যতই অগণতান্ত্রিক, অসাংবিধানিক হোক না কেন তাতে কোন অসুবিধে নেই।

ওই যে একটি প্রবাদ আছে– আমেরিকা যার বন্ধু, তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয়না। সেটি এবার বাংলাদেশের জনগন হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছে।

শুধু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার পতন নয় ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ নামের একটি দেশ প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিশ্বের মানচিত্রে সেই বাংলাদেশকেই মুছে দিতে চাইছে সেই পরাজিত শকুনের গোষ্ঠী।

গোষ্ঠী বলছি এ কারণে যে ২০২৪ সালের জুলাই- আগষ্ট মাসে যা ঘটেছে তাতে সেই মার্কিন ডীপষ্টেট, পাকিস্তান এমনকি চীনও জড়িত।

বাংলাদেশ নামে দেশটির মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এ তিনটি দেশ জড়িত ছিল।

পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, মার্কিন সিআইএ, বর্তমান ইসলামী জঙ্গী এরদোগান সরকার নানাভাবেই বাংলাদেশকে একটি ইসলামী জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত করার মিশন নিয়েই আওয়ামীল সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সেই ‘ ডীপস্টেট’ এর নীলনকশা অনুযায়ী ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছে।

সেই চব্বিশের ‘ মব সন্ত্রাস’ গত এগারো মাস ধরেই স্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর।

বাংলাদেশে হিন্দু মানে ভারতের দোসর। আর ভারত যেহতু শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে সুতরাং ভারত বাংলাদেশের চরম শত্রু এখন।

ড. ইউনুস থেকে শুরু করে তার নেতৃত্বাধীন অসাংবিধানিক- অবৈধ অন্তবর্তীকালীন সরকারের সবাই কোন না কোনভাবে সব কিছুতে ভারতের দোষ খুঁজে বেড়ায়।

অথচ এই ভারত একাত্তর সালে যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অকৃত্রিমভাবে সহায়তা না করতো তাহলে আজ বাংলাদেশে যারা বড় বড় সচিব, সেনা কর্মকর্তা হয়েছেন সেসব আর পেতে হতোনা।

কিন্তু সেই ভারতকেই বর্তমানে সারাক্ষন শত্রু হিসেবে সমালোচনা করা হচ্ছে। আর হিন্দুরা হলো আরও বড় শত্রু বর্তমান সরকারের কাছে।

তবে গত কয়েকমাস ধরে ইউনুস সরকার ও তার অন্যতম দোসর জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দালন ( বৈছাআ)’ র বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে।

দেশের অধিকাংশ নাগরিক চায়– অতিদ্রুত আওয়ামীলীগসহ সব দলের অংশগ্রহনের মধ্য দিয়ে একটি নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।

কিন্তু দেশের বিভিন্ন স্থানে জামাতে ইসলামী, বৈছাআ, বিএনপি, এনসিপিসহ তাদের সহযোগীরা মব সৃষ্টি করে নানা টালবাহানায় শুরু করেছে। এই মব এর বিরুদ্ধে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার- উজ- জামান কড়া ভাষায় হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।

কিন্তু তার সেই হুঁশিয়ারি কোন কাজে লাগেনি। সব কিছু মিলে নাগরিকদের আশংকা এভাবে অরাজকতার চরমে পৌঁছালে একটি গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী।

এরই মধ্যে কেউ কেউ বলছেন– চলে গেলে ক্ষমতার হিসাব চাইবে জনতা! কিছুদিন আগে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ( আসক)’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল- দেশে নয় মাসে ১৭৪ জন মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়েছে।

সেই তথ্যের সাথে আরো বেশ কটি নাম যুক্ত করা যায় যাদের গত কদিনে পিটিয়ে মারা হয়েছে। দেশে গত দেড় দশকে সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু ছিলো বিনা বিচারে হত্যার বিপরীতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র( আসক)’ র তথ্যানুযায়ী দেশে ২০০৭ সালে ২৫৪,২০১৭ সালে ১২৬ আর ২০১৮ সালের ১০ মাসে ৪৩৭ টি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটে।

আর সেক্ষেত্র শান্তিতে নোবেলজয়ী ‘ মব জনক’ মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় গত নয় মাসে পিটিয়ে মারা হয়েছে ১৭৪ এরও বেশি।

স্বাভাবিকভাবেই জনমনে প্রশ্ন আসে কথিত গণঅভ্যুত্থান এর মধ্য দিয়ে আনা পরিবর্তনের আকাঙ্খাকে মাটি চাপা দিয়ে রেপিড একশন ব্যাটেলিয়ন বা RAB এর শাসনের বদলে ‘ মব’ এর শাসন প্রতিষ্ঠিত হলো না?

আর সেই মব এর শাসনটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই মদত দেয়া হচ্ছে।

মানুষকে কেবল পিটিয়ে মারলেই সেটা মব সন্ত্রাস না-এর সাথে ঘরবাড়ি দখল,প্রতিষ্ঠানে হামলা এগুলো ও মব সন্ত্রাস।

অনেক ঘটনার পেছনে মানুষের ক্ষোভ আছে, থাকতে পারে কিন্তু সব সময় ব্যক্তির ক্ষোভ বা চাওয়া সঠিকভাব। যাচাই- বাছাই ছাড়া রাষ্ট্র পূরণ করবে সেটাতো কখনোই হওয়া উচিত নয়।

খেয়াল করে দেখবেন-কারো স্বজন খুন হলে আমরা কী বলি? খুনীদের ফাঁসি চাই।

আমরা সরাসরি ফাঁসির কথা বলি, বিচারের কথা বলি না- কারণ এটা ব্যক্তির ক্ষোভের প্রকাশ কিন্তু রাস্ট্র কি ধরেই ফাঁসি দেয়? দেয় না।

রাষ্ট্রযন্ত্র বিচারের আওতায় আনে, আইন অনুযায়ী প্রতিকার করে। কেউ নির্দোষ হয় বা কারো লঘু বা গুরুদণ্ড হয়।

গত দেড় দশকে যে পরিবারের একজন সদস্য গুমের শিকার হয়েছেন তার আবেগ আর যার শরীরে ফুলের টোকা পড়েনি তার আবেগ এক হবে না অথবা ঘি তেলে যে দিন পার করেছে তার অনুভূতি আর যে ধানক্ষেতে ঘুমাতে বাধ্য হয়েছে তার অনুভূতিও এক নয়।

কিন্তু সরকার কারো আবেগ বিবেচনা না করে ন্যায় অন্যায় এর হিসাব করে তার প্রতিকার করবে– এটাই সুশাসন।

কিন্তু আমাদের সরকার আইনী প্রতিকারের দিকে যায়নি। কথিত গণ অভ্যুত্থানে সামনে থাকা নেতৃত্ব থেকে বিদেশে থাকা ইউটিউব ব্যবসায়ী এবং সবশেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব যিনি ডাষ্টবিন সফিক নামে সমধিক পরিচিত সেই সফিকও মব সন্ত্রাস এর পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

এই সময়কালে সেনাপ্রধান এর একাধিকবার এই নতুন উপদ্রব কঠোর হাতে দমনের কথা বলেছিলেন এবং রংপুরে মব সন্ত্রাসীদের ডেকে “শরীরে রক্ত থাকতে এটা বরদাস্ত করা হবেনা” বলে এক সেনা কর্মকর্তার কঠোর বার্তা মানুষকে আশার আলো দেখালেও তা দীর্ঘায়িত হলো না কেন?

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে– আমাদের সেনাবাহিনী আফ্রিকার জঙ্গলে শান্তি আনতে পারলে নিজ দেশে কেন পারছে না? পারছেনা তার কারন হলো– ‘ লোভ ‘।

সেনাবাহিনীর প্রতিও মানুষের আস্থা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। গত বছর ৫ আগষ্ট সেনাপ্রধান বলেছিলেন আমার উপর ভরসা রাখুন কিন্তু তিনি সেই আশ্বাস রক্ষা করতে পেরেছেন কিনা তিনি সেটা কখনো ভেবেছেন তিনি?

তবে একটি স্বার্থান্বেষী মহল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে উস্কানী আছে- তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা আছে- তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা থাকলেও এই বাহিনীর প্রতি মানুষের এখনো কিছুটা আস্থা আছে।

একটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারত বিরোধিতার নামে যারা অবিরত সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে তাদের মনোবল ভাঙতে চায় তাদের আমরা ভারত বিরোধী সেরা ইনফ্লুয়েন্সার মনে করি।

নাগরিকদের আজ প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে-আমার সেনাবাহিনী মেজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়েও কেন কঠোর হতে পারছে না- জননিরাপত্তা দিতে পারছে না।

একদিকে সেনা প্রধান বারবার মবের বিরুদ্ধে যে কঠোরতার বার্তা দিচ্ছেন সেটার কোন প্রতিফলন বা কোন পদক্ষেপ দেখছিনা কেন?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যতো খারাপ দিক ছিলো তার সাথে নতুন উপসর্গ যুক্ত হলো-মব সন্ত্রাস এবং তা আবারো রাস্ট্রের মদতে।

পরিবর্তন বলতে আমরা পরমত সহনশীলতার-ভিন্নমত চর্চার সুযোগ-আইনের শাসন- নাগরিক নিরাপত্তা চেয়েছিলাম।

এমনটাও বলতে শুরু করেছেন এই কথিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বা সমর্থন করেছেন তাদের অনেকে।

কিন্তু গত এগারো মাসে তার বিপরীতে জানিয়ে দেয়া হলো,এখানে ভবিষ্যতের রাজনীতি ভিত্তি হবে আবারো প্রতিহিংসার- শক্তি আর দাপট নিয়ে টিকে থাকার রাজনীতি!

গতবারের আগষ্টের একটা শ্লোগান খুব মনে পড়ে- উল্টে দিতে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা।

কিন্তু মব সন্ত্রাসের জনক ইউনূস শাহীর মাত্র এগারো মাসের মাথায় অনেকে বলা শুরু করেছে- চলে গেলে ক্ষমতা হিসাব নেবে জনতা।

আমরা গত বছরের ৫ আগষ্ট থেকে দেখলাম একটি লুটপাটের জাতিকে, একটি সন্ত্রাসী- বিধংসী জাতিকে, নিজেদের মুক্তিযুদ্ধ- স্বাধীনতার গৌরবকে ধ্বংস করা জাতিকে।

নিজের দেশের জনককে অস্বীকার করা জাতিকে। সেই সাথে দেখছি একটি জঙ্গী জাতিকে। প্রশাসন, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি সবইতো শেষ।

যে দেশের ছাত্ররা তাদের শিক্ষককে অপমান করে গলায় জুতোর মালা পড়ায়, যেখানে চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে বলে– আপনি আপনার যোগ্যতায় ভিসি হননি, হয়েছেন আমাদের দয়ায়। সেখানে আর কি ই বা আশা করা যায়!

# নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, প্রাবন্ধিক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *