জঙ্গী-প্রতারক ইউনুস সরকারের আমলে বা ইউনুসীয় জমানায় রংপুরের ঘটনা আবারো প্রমাণ করলো বাংলাদেশে হিন্দুরা আর বাংলাদেশে থাকতে পারবেনা। থাকলেও মুসলমানের সাথে থাকতে পারবে না !
কারণ সরকারি প্রশাসনযন্ত্র, এদেশের বিভিন্ন ইসলামী কট্টরপন্থী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের কথাবার্তা-আচরণ তাই প্রমাণ করে। যেসব রাজনৈতিক দল নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করে তাদের অবস্থানটিও আমরা দেখেছি গত কয়েক দশক ধরে। সুতরাং কোন ভরসায় বাংলাদেশে হিন্দুরা থাকবে বলুন ?
এই দেশকে যে মাতৃভূমি-পিতৃভূমি- তাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটিকে , এই দেশের মাটি-জলবায়ুকে নিজের বলে আঁকড়ে ধরেছিল, ধরে আছে এখনো থাকতে চায় সেখানে কি থাকার মত, বাঁচার মতো কোন পরিস্থিতি কোন সরকার তৈরী করেছে ? এর একটিই উত্তর- না না এবং না।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাওয়া পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ট সংবিধান ১৯৭২ এর সংবিধানকে কাঁটাছেঁড়া করে পদদলিত করা হয়েছে। আরও করবে এই জঙ্গী ইউনুস সরকার। একটি ইসলামী তালেবানী রাষ্ট্র ঘোষণার বাকী রেখেছে মাত্র।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তৌহিদী জনতা রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ১৮টি হিন্দুবাড়ী ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। পুরুষ-মহিলা নির্বিচারে সবাইকে বেদম প্রহার করেছে। মানুষ আতঙ্কে একাত্তরের মত গ্রামছাড়া হচ্ছে। এটি ঘটেছে প্রকাশ্য দিবালোকে, পুলিশের সামনে। পরে সেনাবাহিনী এসে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত করে, যদিও উত্তেজনা কমেনি।
কিন্তু দেখা গেলো জীবনের ভয়ে ভাংচুর ও লুটপাটের পর যা কিছু অবশিষ্ট আছে কোন কোন পরিবারের তারা তা নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। কিন্তু যেখানেই যাচ্ছেন বা গেছেন তারা সেখানেওতো নিরাপত্তার কোন আশ্বাস নেই। নিশ্চয়তা নেই।
এসব দৃশ্য দেখে আমার মত অনেকের ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের কথাই মনে পড়ে। সেসময় এদেশের সব মুক্তিকামী মানুষই অত্যাচারিত-নির্যাতিত হয়েছিলেন। কিন্তু পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও তাদের সৃষ্ট রাজাকার, আলবদর, আলশামস ক্যাডারদের মূল টার্গেট ছিল হিন্দুরা।
তখন প্রায় এককোটি হিন্দু নরনারীকেই এদেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আমি মুসলিম ভাইদের কাছে, গবেষকদের কাছে প্রশ্ন রাখি- কতজন মুসলিমকে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল একাত্তরে একটু মনে করে দেখুনতো ! এসব প্রশ্ন করলে আপনারা হয়তো বলবেন আমি হিন্দুদের দালালি করছি, ভারতের দালালি করছি। যাই বলুন না কেন এটাই নির্মম সত্যিকার বাস্তবতা।
বাংলাদেশ কিভাবে হিন্দু শূন্য হচ্ছে তার স্পষ্ট এবং পরিসংখ্যানভিত্তিক গবেষণা করে জানিয়েছেন এ দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ-গবেষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত গ্রেফতার হয়েছেন, এ সংবাদটি জানার পর বিষয়টি হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি কেন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাঁর মতো এমন অসাম্প্রদায়িক ও ইসলামী জঙ্গীবাদ বিরোধী লোক খুব কমই আছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক, প্রাবন্ধিক-প্রামান্য চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবিরও একই ঘরানার লোক। তাই তাঁকেও গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করছে এই জঙ্গী ইউনুস সরকার।
দুজনেই চরম অসাম্প্রদয়িক। মুক্তিযুদ্ধ ও মানবাধিকার রক্ষা, জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে ও ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নিপীড়সের প্রশ্নে কঠোরভাবে আপোষহীন। কিন্তু তাঁরা দুজনেই আজ ইউনুসীয় শাষণে-রুদ্ররোষে কারাগারে নির্যাতনের শিকার !
প্রফেসর আবুল বারকাত তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে কিভাবে শত্রু সম্পত্তি আইন অর্পিত সম্পত্তি নাম ধারণ করে হাজার হাজার একর হিন্দু সম্পত্তি প্রতিনিয়ত দখল হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। তিনি তার ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলেছেন-১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু। এই নিরুদ্দেশ প্রক্রিয়ার প্রবণতা বজায় থাকলে আগামী দু’তিন দশক পরে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনও মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ড. বারকাতের গবেষণায় আরও বলেছেন, বিভিন্ন সময়কালে প্রতিদিন গড়ে নিরুদ্দেশ হওয়া হিন্দুদের সংখ্যা সমান নয়, যেমন-১৯৬৪ থেকে ১৯৭১ পাকিস্তানের শেষ ৭ বছর প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৭০৫ জন হিন্দু। ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৫২১ জন।
১৯৮১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন নিরুদ্দেশ হয়েছেন ৪৩৮ জন। ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতিদিন ৭৬৭ জন হিন্দু দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আর ২০০১ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে ৬৭৪ জন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
বাংলাদেশের গত ৫৪ বছরের ইতিহাসে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ও শাহরিয়ার কবিরের মত এমন মানবতাবাদী-ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় দরদী ব্যক্তিদের হয়ত আমরা পাবোনা কখনোই। সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের অনেকেই দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা বলেছেন, কিন্তু গবেষক ড. বারাকাত শুধু কথা বলেননি তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে ঘটা বঞ্চনা, অন্যায় ও অসাম্যের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট গবেষণার মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
লেখক শাহরিয়ার কবিরও তারা নানা বই, প্রবন্ধে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন দেশে ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও দেশে। তাই কিছু কিছু ব্যক্তির কাছে এঁরা বড় অপরাধী !!
নিউইয়র্কে অবস্থানরত মানবাধিকার সংগঠক ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা শিতাংশু গুহ লিখেছেন–‘ প্রথম আলোর ভাষ্যমতে বাইরে থেকে লোক এসে মাইকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ জড়ো করে হিন্দুবাড়ীতে আক্রমণ চালায়।
প্রতিটি ঘটনার সাথে লুটপাট থাকে। থাকে মন্দির ভাঙ্গা, মহিলাদের সম্মানহানি। একাত্তরে শতভাগ হিন্দুবাড়ী লুট হয়েছিলো। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা সবার আমলে লুটপাট হয়েছে। জাতি গণভবন লুটপাট দেখেছে। কোন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান-উপজাতি, আদিবাসী কিন্তু লুটপাটে অংশ নেয়না। হিন্দুরা জঙ্গী হয়না।
তিনি লিখেছেন-রিট পলিটেনিক ২৩-২৪ সেশনের কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের ৩য় বর্ষের ছাত্র রঞ্জন রায় এর বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি নবী মুহাম্মদের বিরুদ্ধে ‘কটুক্তি’ করেছেন। পুলিশ ছেলেটিকে গ্রেফতার করে, বলা হচ্ছে, তা না হলে ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলতো।
রঞ্জনের বিরুদ্ধে কলেজের মেইন গেটে রবিবার দুপুর ১টায় প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকা হয়, তবু প্রশাসন ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু আগের রাতেই তারা রঞ্জনকে গ্রেফতার করে? রঞ্জনের ফেইসবুক দুই সপ্তাহ আগে খোলা হয়েছে। তিনি আদৌ সেটি খুলেছেন কিনা, বা অন্যকেউ খুলেছেন কে জানে? বিবিসি বলেছে, যেহেতু এটি ভেরিফাইড পেইজ নয়, তাই রঞ্জন নবীকে অপমান করেছেন কিনা তা প্রমাণ সাপেক্ষ। বিবিসি আরো বলেছে, ধর্ম অবমাননার যত ঘটনা ঘটেছে এর প্রায় পুরোটাই প্রমাণ করা যায়নি।
এবারের রংপুরের ঘটনার পর সরকার ও আইন -শৃঙ্খলা বাহিনী চুপ। সচরাচর তারা চুপ থাকতে পছন্দ করেন, পরে বিবৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির দেশ ! এটি শুধু এই সরকার নন, অতীতের সকল সরকার এটি করেছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সাথে রাজনৈতিক যোগসাজস থাকে।
সরকার ও প্রশাসনের প্রচ্ছন্ন মদত থাকে, সবাই চায় হিন্দু খেদাতে। বাংলাদেশের মুসলমান হিন্দুদের সহ্য করতে পারেনা। তারা চায়না হিন্দুরা থাকুক। বাংলাদেশের হিন্দুরাও আর মুসলমানের সাথে থাকতে চায়না। এভাবে কতকাল থাকা যায়? বেশিরভাগ মুসলমান স্বীকারই করেন যে হিন্দুরা অত্যাচারিত?
আপনারা ভাবছেন আমি ঢালাওভাবে মুসলমানের কথা বলছি কেন? কারণ গত ৫৪ বছরে হিন্দুরা বঞ্চনা ছাড়া তাদের কাছ থেকে কিচ্ছু পায়নি (তবে অতিশয় ক্ষুদ্রাতি-ক্ষুদ্র ক্ষমতাহীন একটি গ্রুপ এর বাইরে)।
ধর্মের অবমাননা নামক ‘ইসলামী মৌলবাদী অত্যাচার’ শুরু হয়েছে ২০১২-তে রামু থেকে। যেই উত্তম বড়ুয়া ধর্ম অবমাননা করেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল, তাঁকে আজো পাওয়া যায়নি। তৌহিদী জনতা উত্তম বড়ুয়ার নামে নিজের ধর্মকে অবমাননা করে।
ফলশ্রুতিতে গ্রামের পর বৌদ্ধগ্রাম ধ্বংস হয়ে যায়। কুমিল্লায় ইকবাল দেবীদুর্গার পায়ে কোরান রেখে ধর্মের অবমাননা করেছিল, ১৯টি জেলার হিন্দুদের ওপর নেমে এসেছিলো তান্ডব। নাসিরনগরে জাহাঙ্গীর ধর্মের অবমাননা করেছিলো পুরো শহরের হিন্দু বাড়ীগুলো আগুনে পুড়িয়ে ছাই হয়েছিল।
এর কোনটা’র কিন্তু বিচার হয়নি, শেখ হাসিনা বিচার করেননি। ২০০১-র পর হিন্দুদের ওপর যে নারকীয় অত্যাচার হয়, খালেদা জিয়া এর বিচার করেননি। এমন কি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেও এর বিচার করেননি। সবাই বলেছেন বাংলাদেশে চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান!
শিতাংশু গুহের লেখা থেকে উদ্ধৃত করে অবস্থাটি একটু বোঝানোর চেষ্টা করেছি মাত্র। এরই মধ্যে বাংলাদেশের সরকারি প্রশাসন সেনা-পুলিশ–ম্যাজিষ্ট্রেট সমন্বয়ে রাজধানীর খিলক্ষেতে মন্দির ও প্রতিমা ভাঙ্গচুর করেছে। এছাড়া লালমনিরহাটে সনাতনী নরসুন্দর এর উপর মব সন্ত্রাস ও জেলে ঢুকিয়েছে।
কুমিল্লার মুরাদনগরে এক সনাতনী নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ ও তা ভিডিও করে ভাইরাল করেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ব বিদ্যালয়ের সনাতনী শিক্ষক ড. কুশল বরণ চক্রবর্তী কে মব সন্ত্রাস সৃষ্টি করে পদোন্নতি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে না দেয়া এবং তাকে চাকরিচ্যুত করেছে। এই কি তবে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নমুনা ?
লালমনিরহাটে একজন বৃদ্ধ নরসুন্দর কে চুল কেটে টাকা কম দেয়ার প্রসঙ্গে অনাকাংক্ষিত বাক বিতন্ডার জের ধরে ধর্ম অবমাননার তকমা দিয়ে মব সন্ত্রাসীরা তাকে এবং তার ছেলেকে আতঙ্ক সৃষ্টি করে মারধর করে।
অথচ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ৮০ বছরের একজন বৃদ্ধ কোন ধর্ম অবমাননা করে মবের স্বীকার হওয়ার মত ঘৃণ্য ও দুঃসাহসিক কাজ করবে এটা বিশ্বাস করা তো দূরের কথা বরং ভিত্তিহীন। এখানেও ইসলামী জঙ্গীদেরকে সন্তুষ্ট করতে সত্যি মিথ্যা যাচাই না করেই পিতা পুত্রকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সত্যি মিথ্যা যাচাই বাছাই করার দায়িত্ব প্রশাসনের।
কুমিল্লার মুরাদনগরে একজন সনাতনী নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ ও তার ফুটেজ ধারণ করার মত নিন্দনীয় ঘটনায় শুধু সনাতনী সমাজ নয়,বরং বাংলাদেশের প্রতিটি ধর্মের লোক নীরবে কেঁদেছেন এবং তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এই ঘটনা সমগ্র জাতিকে লজ্জিত করেছে। এখানেও প্রতীয়মান হয় সারা দেশে হিন্দু সমাজ কতটা নিরাপদে আছে। এই জঙ্গী সরকারের মনোভাব কি তা তো স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে।
২০২৪ এর ২২ ডিসেম্বর দৈনিক কালবেলা পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উল্লেখ করে সাংস্কৃতিক সংগঠক অনুপ সাহা বললেন, একই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় – ‘হিন্দুদের ওপর সহিংসতা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার তথ্য বিভ্রান্তিকর’ – সরকারের প্রেস উইং। অপরদিকে একই পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় – ‘নাটোরে মহাশ্মশানের সেবায়েতকে হত্যা।’ – নাটোর প্রতিনিধি।
সরকার আগেও বলেছে, এখনও বলছে – ভারতীয় মিডিয়ার এ-সব তথ্য বিভ্রান্তিকর ও অতিরঞ্জিত। সরকার এ-সব বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকতে সকলকে অনুরোধও জানিয়েছে।
অন্যদিকে একই পত্রিকায় নাটোরে মহাশ্মশানের সেবায়েত হত্যার খবর। হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ঐক্য পরিষদ সেবায়েত হত্যা, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের রাধাগোবিন্দ মন্দির ও পলাশকান্দা কালী মন্দির এবং দিনাজপুরের মন্দির ভাঙচুরের নিন্দা জানিয়েছে।
জনগণের জন্য সবটাই ‘বিভ্রান্তিকর’!
এই ‘বিভ্রান্তি’, ‘রঞ্জিত’, ‘অতিরঞ্জিত’ নিয়ে এবারে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, গতবছর (২০২৪) এর ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর থেকে।
প্রথম দিকে সবটার অস্বীকৃতি, মিডিয়ার নীরবতা, পরবর্তীতে কিছুটা স্বীকৃতি, মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতারের খবর প্রকাশ। অন্যদিকে ভারতীয় মিডিয়ার ‘অতিরঞ্জন’। সব মিলে বাংলাদেশে ‘সাম্প্রদায়িক-পরিস্থিতি ‘ অস্বাভাবিক, এটা নিশ্চয়ই বলা যায়।
এরই সুযোগে – এর, ওর উপর দোষারোপের রাজনীতিতো চলছেই যথানিয়মে – অক্টোবর মাসে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব ফকরুল ইসলাম বলেছেন – হিন্দুদের উপর যত অত্যাচার, জায়গা-জমি, সম্পত্তি দখল, বেশির ভাগ আওয়ামীলীগ করেছে। সেদিন প্রশ্ন তুলেছিলাম – কম ভাগে বিএনপি’র কাছে কত সম্পত্তি আছে – এ-রকম কোন পরিসংখ্যান তাঁর কাছে আছে কিনা?
রাজনীতিবিদরা এ সবের ধার ধারেন না, তাঁদের রাজনীতি তাঁরা করবেনই। তাদের কাছে ‘রাজনীতি’টাই সব।
কিন্তু গত ২০২৪ এর ডিসেম্বরেই বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য ‘কলামিস্ট’ও তাঁর কলামে লিখলেন – ‘…হিন্দুদের বাড়ি, জমি বা মন্দির-মঠের জায়গা দখলে আওয়ামীলীগের নেতারাই বেশি অগ্রণী ছিলেন…’। তাঁর কাছে কী পরিসংখ্যান আছে – তা তিনি উল্লেখ করেননি, তাঁর লেখায়।
অপ্রিয় কথা বলতে দ্বিধা যাঁরা করেন না, তারা বলেন – অন্তরে ব্যক্তিগত প্রত্যাশাকে জাগ্রত রেখে, সরকারের অনুকম্পা লাভের অপেক্ষায় থেকে, আর যাই হোক – ‘নিরপেক্ষ রাজনৈতিক-কলামিস্ট’ হওয়া যায় না!
সরকার এখনও একজন সংসার ত্যাগী সন্নাসী চিন্ময় দাস (চিন্ময় প্রভু)কে আটক রেখেছে। এমনকি উচ্চ আদালতের আইনজীবীরা এসেও কোন সুরাহা করতে পারেননি। উপরন্তু জুনিয়র এডভোকেট কর্তৃক শারিরীকভাবে হেনস্তা হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এমন হাজারো উদাহরণ দেয়া যাবে। কিন্তু তাতে পাঠক নিশ্চয়ই বিরক্ত হবেন। ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটবে আপনাদের। ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত যদি পরিসংখ্যান দেই তাহলে আরো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে আপনাদের মন।
কেন কি কারণে এদেশ থেকে হিন্দুরা সরবে-নীরবে চলে যাচ্ছে তার জন্মভূমি ত্যাগ করে তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন এদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ? নাকি আপনারা ভাবছেন -ভালোইতো, হিন্দুরা চলে গেলে তাদের ঘর-বাড়ি-জায়গা-সম্পত্তি সব আমরা দখল করতে পারবো। ভোগ করতে পারবো মহানন্দে।
কিন্তু একটিবার ভাবুনতো শতভাগ মুসলিম বা ইসলাম ধর্মাবলম্বী দেশগুলো বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম নাগরিক দেশগুলো কি শান্তিতে আছে ? প্রতিনিয়ত মারামারি-কাটাকাটি কারা কারা করছে সেখানে ? আর বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদেরকে যদি আলাদা করে দিতেই হয় তাহলে তাদের জন্য আলাদা আবাসস্থল করে দিতে হবে। কারণ তাদেরও যে পরিমাণ নাগরিক রয়েছে, যে পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে সেগুলোরও ন্যায্য হিস্যা দিয়ে তারপরে সে চিন্তা করবেন দয়া করে।
না হলে কিন্তু ফুঁসে উঠবে এখানকার হিন্দুরা- এটি বিবেচনায় রাখতে বলি। যদি ফুঁসে ওঠে তাহলে কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ইসলাম ধর্মঅবলম্বী নাগরিকরাও ভালো থাকবেন না নিশ্চয়।
এ বিষয়ে আরো লেখার রয়েছে। তবে তা আরো কিছুদিন পরে লিখবো আশাকরি।
# ইশরাত জাহান, লেখক, প্রাবন্ধিক, নারী অধিকার সংগঠক।