একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছিল সেই দেশপ্রেম-নীতি-নৈতিকতা নিয়ে বর্তমান সেনাবাহিনীর কি আছে বাংলাদেশে ?
হঠাৎ করে এ প্রশ্ন কেন তুলছি তা হয়তো ভাবছেন অনেকেই। আর এমন একটি অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে এই “ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী” নিয়ে আমরা আমজনতা কিছু বলতে পারবো না ? কেন সেনাবাহিনী কি সব আলোচনা-সমালোচনার উর্ধ্বে ?
আরে ভাই যেখানে ধর্মীয় কিতাবে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা-হচ্ছে সেখানে মানুষের সমালোচনা করা যাবেনা ? সেনাবাহিনীর সদস্যরা তো এদেশেরই মানুষ । আপনার আমার সন্তান, কারো ভাই কারো স্বামী বা কারো স্ত্রী। তাহলে তাদের নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করা যাবেনা কেন শুনি ? করলে গর্দান থাকবেনা গর্দানের জায়গায় ?
ওনারা মানে সেনাসদস্যরা উর্দি পড়ে আমার দেশের সাধারণ জনগণের ওপর আমাদের রক্ত পানি করা ট্যাক্সের পয়সায় কাড়ি কাড়ি টাকা বেতন নেবেন আর আমাদের সাধারণ নিরীহ-নিরস্ত্র জনগণের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে খুন করবেন ! ওনাদের পায়ের বুটের তলায় পিষ্ঠ হবে আমাদের সন্তান ? আমাদের ভাই ?
এই সেনাবাহিনী ‘পবিত্র কোরআন শরীফ’ ছুঁয়ে শপথ করবেন সংবিধান ও দেশমাতৃকাকে রক্ষার জন্য কিন্তু করবেন তার উল্টোটা -সেজন্যতো সেনাবাহিনীকে পোষা হয়নি জনগণের ট্যাক্সের পয়সায়।
রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার সবচেয়ে বেশি ভোগ করবেন তারা। কিন্তু ছড়ি ঘুরাবেন এদেশের সাধারণ জনগণের ওপর এ কেমন “দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী” আমাদের ?
এসব প্রশ্ন কিন্তু ঘুরপাক খায় সাধারণ জনগণের মধ্যে। কেউ ভয়ে কিছু বলেন না। রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক হতো রাষ্ট্র যদি সত্যিকার অর্থেই জনগণের হতো তাহলে কখনোই এমনটি হতোনা। এসব সাধারণ বিষয় বুঝতে কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হতে হয়না। রাজনীতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানেরও প্রয়োজন হয়না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে চাকরিরত বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর মানে সশস্ত্র বাহিনীর অনেকেই ছিলেন নিষ্পেষিত-নির্যাতিত। তারা অনেকেই সেই পাকিস্তানী পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
অনেকেই শহীদ হয়েছেন দেশমাতৃকাকে পাকশত্রু থেকে মুক্ত করতে গিয়ে। তাদের জন্য আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণতি। সশ্রদ্ধ সালাম হে বীর সন্তানেরা। আপনাদের ত্যাগ-মহিমা আজীবন গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে এদেশবাসী। কেউ যদি সেখানে কোন কথা বলেন আমরা অবশ্যই তাকে হানাদার পাকি দোসর হিসেবে চিহ্নিত করবো।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে অন্য জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী কি করে মুক্তিযুদ্ধের-স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের কালোরাত্রিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মত এতবড় সিংহহৃদয়ের মানুষকে নির্মমভাবে খুন করে ?
শেখ রাসেলের মতো এক নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে যে কিনা বার বার মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য আর্তচিৎকার করছিল ! সেই সেনাবাহিনী কি করে শেখ জামালের নবপরিণীতা বধূকে খুন করে যার হাত থেকে তখনও মেহেদীর রঙ মুছে যায়নি! একটি বারের জন্যও কি তাদের বুকে রহম জাগেনি সে প্রশ্ন ওঠে বার বার।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যত রাষ্ট্রপতি, সেনাকর্মকর্তা মানে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা-সদস্য খুন হয়েছেন তা কিন্তু এই সেনাবাহিনীর হাতেই।
এদেশের কোন সাধারণ মানুষ কিন্তু কোন সেনা বা সশস্ত্র বাহিনীর কাউকে হত্যা করেনি। পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের নির্মম হত্যাকান্ডের কিছুদিন পরে এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে গোপন সায়দাতা সেনাকর্মকর্তা জিয়াউর রহমান ( যাকে বিএনপি ‘স্বাধীনতার ঘোষক’ হিসেবে দাবি করে আসছে) এর ষড়যন্ত্র ও নির্দেশে কয়েক হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা-সদস্য হত্যা করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান প্রকাশ হয়েছে আজ পর্যন্ত ? না হয়নি।
যেই কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে বন্দীদশা থেকে বের করে আনলেন, তাকেই কিনা জিয়াউর রহমান বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে হত্যা করলেন ! ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চারনেতাকে হত্যা করলো কারা ? কোন সাধারন জনতা ? উত্তর হলো না।
এদেরও হত্যাকারি সেই সেনাবাহিনী।বিমান বাহিনীর অসংখ্য কর্মকর্তা-সদস্যকে কারা হত্যা করেছে ? সোজা উত্তর হলো জিয়াউর রহমানের নির্দেশে তৎকালীন সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনী।
কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিণতি দেখুন এই জিয়াউর রহমান সামরিক পোষাক পড়েই রাজনীতিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন নানা কৌশলে।
কিন্তু ১৯৮১ সালের মে মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে নিহত হলেন সেনাবাহিনীর হাতেই। আবার তার হত্যাকারি হিসেবে যাকে সন্দেহ করা হয়েছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাস তথা ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুর ও তার অনুসারি কয়েকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। জেনারেল মঞ্জুর কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা ছিলেনিএটি ছিল সেনাবাহিনী থেকে মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদেরেকে নিশ্চিহ্ন কর দেয়ার একটি গভীর ষড়যন্ত্র।
মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে তখন পুলিশের কাছ থেকে জোর করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছিল জিয়াউর রহমান হত্যাকান্ডের পেছনে মূল ষড়যন্ত্রকারিদের আড়াল করার জন্য। বিএনপি কিন্তু এ নিয়ে কখনো উচ্চবাচ্য করেনি।
কারণ জেনারেল এরশাদ তখন বেগম জিয়াকে মহামূল্যবান বাড়িসহ নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছিলেন। শুধু কি তাই ? পরবর্তীতে বেগম জিয়াকে বিএনপির চেয়ারপারসন করার পেছনে এই এরশাদের ভূমিকা ছিল অনেক।
বেগম জিয়াকে সেনানিবাসের ভেতরে মইনুল রোডের মহামুল্যবান বিশাল বাড়িটিও দিয়েছিলেন এরশাদ। আর সেখানে মানে সেনানিবাসের মধ্যে বসেই রাজনীতি করেছেন বেগম জিয়া। অথচ সেনানিবাস সবসময় রাজনীতিমুক্ত এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে পৃথিবীর দেশে দেশে।
(এরপরে গুলশানেও আরেকটি প্রাসাদোপম বাড়ি দেয়া হয় বেগম জিয়াকে।) শুধু ব্যাতিক্রম বাংলাদেশ। পাকিস্তানের কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ পাকিস্তানকে যদি দেশ হিসেবে ধরতে যাই তাহলে আর গণতন্ত্রের কথা না বলাই ভালো, কারন দেশটির রাজনীতি-ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণই করে সেনাবাহিনী।
প্রসঙ্গত: জিয়াউর রহমানকে যখন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে খুন করা হয় তখন সেনাপ্রধান হিসেবে ছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত লে: জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।
তিনি কিন্তু একাত্তর সালে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তার মত এমন যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন ও তাদের পারপাস সার্ভ করেছিলেন তাদেরকে কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে উচ্চতর পদে পদায়ন করা হযেছিল তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের পরামর্শে।
এ নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে তখন থেকেই পাকিস্তান প্রত্যাগত ও মুক্তিযোদ্ধা সেনাসদস্যদেও মধ্যে একধরনের বিভেদ তেরি হয়েছিল। হওয়াটাই স্বাভাবিক। যারা দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তাদেরকে প্রাধান্য না দিয়ে পাাকিস্তান প্রত্যাগতদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। যেটি ছিল অত্যন্ত চরম একটি ভুল সিদ্ধান্ত তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারের।
এভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকি মনোভাবের প্রাধান্য বিস্তার লাভ করতে থাকে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। জিয়াউর রহমানকে কৌশলে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল এরশাদ হয়ে গেলেন দেশের প্রেসিডেন্ট। চিন্তা করুন কি সুন্দর প্ল্যান সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এর। এই ডিজিএফআইতো পুরাটাই পাকিস্তানী ভাবধারায় তৈরী।
জিয়াউর রহমানতো সেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। একজন বাঙ্গালি অফিসারকে কখনো পাকিস্তানীনী বাহিনী তাদের সেনা গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয় ?
তিনি নিশ্চয়ই ঊর্ধ্বতন পাকি সেনাদের বিশ্বস্ত ও অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন বলেইতো জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তান আমলেই ওই পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়টি ভাবেননা অনেকেই। কিন্তু এসব বিষয় ভাবতে হয়।যদি বলি জিয়াউর রহমান ছিলেন “বাইচান্স মুক্তিযোদ্ধা”- এর অত্যুক্তি হবেনা।
একটু খেয়াল করে দেখুন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়কার সেক্টর কমান্ডারদের । সবাই নিজ নিজ সেক্টরে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও কোন ইতিহাসের বইতে বা কারো লেখায় আজ পর্যন্ত কেউ দেখেছেন যে কেউ লিখেছেন জিয়াউর রহমান অমুক জয়গায় সরাসরি যুদ্ধ করেছেন ?
কেউ কেউ বলবেন- কমান্ডারতো ময়দানে সরাসরি যুদ্ধ করেন না, প্ল্যান দেন আর কমান্ড করেন মাত্র। কিন্তু বাংলাদেশের অন্য সেক্টর কমান্ডারদের বীরত্বগাঁথা দেখুন দয়া করে।
যা আওয়ামীলীগ সভানেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও রোধ করতে পারেননি। কারণ পাকি বীজ সর্বত্র ছড়িয়ে গিয়েছিল, এখন তা বৃক্ষ হয়ে দাড়িয়েছে। আর সেই প্রধানমন্ত্রী সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মোস্তাফিজ এর মেয়ের জামাই ওয়াকার-উজ-জামান কে-ই সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিলেন। ভেবেছিলেন তার ফুপাতো বোনের জামাই জেনারেল ওয়াকার তার পক্ষে থাকবেন।কিন্তু ওয়াকার যে জামায়াতের খাস লোক তা কি খোঁজ খবর নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ?
আরো একটি বিষয় এখানে উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো ডিরেক্টর জেনারেল অব ফোর্সেস ইনটেলিজেন্স হিসেবে শেখ হাসিনা যাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তিনি ছিলেন মূলত জামায়াতে ইসলামীর হার্ডকোর মানুষ।
তিনি সবকিছুই ফাঁস করে দিতেন জামায়াত ও মার্কিনীদের কাছে। আর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বিভিন্ন পদে যারা ছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন বর্ণচোরা। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তির মদদপুষ্ট। এমন নড়বড়ে গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে আর যাই হোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন সরকার টিকে থাকতে পারেনা।
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীও হামলা করতে সাহস পায়নি। যা এই স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাসদস্যদের উপস্থিতিতে মানে তাদের সহায়তায়ই বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। পুড়িয়ে ধ্বংস করা হলো।
গণভবন লুট করা হলো ২০২৪ এর ৫ আগষ্ট। সেনা সদস্যদেরকে দেখলাম বিকৃত উল্লাসে তারা জাতির পিতার ভাষ্কর্য ভাঙতে। স্বাভাবিকভাবেই তখন প্রশ্ন জাগে এই কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা “ দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ” ?
তার একটিই উত্তর–এই সেনাবাহিনী কখনোই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সেনাবিাহিনী নয়। এরা নির্ঘাত পাকি বীর্যের-পাকি ধ্যানধারণার সেনাবাহিনী। নাহলে তারা কখনো এমন সব জঘন্য অপকর্ম করতে পারেনা।
তাই যদি না হতো তাহলে যেই সেনাবাহিনী সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছে কোরআন ছুঁয়ে সেই সেনাবাহিনী কিভাবে সেই শপথের অবমাননা করে ? এটি কি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ইসলামের মূল পবিত্রগ্রন্থ বা আল্লাহর কিতাব হিসেবে মানি আমরা সেই কোরআনকে অবমাননা নয় ? এটি কি ধর্মীয় অবমাননার মধ্যে পড়েনা হে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ?
সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন থেকে সংবিধান রক্ষা বা তার নেয়া শপথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে সেই ১৯৭৫ সালেই। তারপর থেকে তাদের মধ্যে শুধু ক্ষমতা-অর্থের লোভ ঢুকেছে। এই লোভই শেষ করছে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে। দেশের সশ্রস্ত্রবাহিনী যদি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে সেখানে আর নীতি-নৈতিকতা থাকবে কিভাবে ?
তাদের এখন ব্যাংক, হোটেল, কনস্ট্রাকশন ব্যবসাসহ নানা ধরনের ব্যবসা রয়েছে। আর রয়েছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে গিয়ে হাজার হাজার ডলার ইনকামের ধান্ধা।
বাংলাদেশের বড় বড় কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে সেনাবাহিনীর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এই ব্যবসা বাণিজ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলেই বেশি জাঁকিয়ে বসেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর যে সামরিক সচিব ছিলেন মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন যিনি ছিলেন জামায়াতের ইসলামীর ঘনিষ্টজন। ইসলামী দেশগুলোর সাথে ছিল বিশেষ সখ্যতা।
২০১৯ সালে তার মৃত্যুতে ওআইসি ( অর্গানাইজেশন অব ইসলামি কনফারেন্স) শোকবাণী পাঠিয়েছিল।
লেখাটি শেষ করি সাম্প্রতিককালে গত জুলাই ১৬ এবং তার পরবর্তীতে গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে তা দিয়ে। সেনাবাহিনী বহিশত্রু হামলা থেকে রক্ষাসহ দেশের সংবিধানকে রক্ষা করার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে- এটাই স্বাভাবিক।
২০২৪ সালে ‘ ইসলামী জঙ্গী ক্যু’ থেকে সরকারকে রক্ষা করেনি তারা। রক্ষা করেনি দেশের সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে। রক্ষা করেনি গণভবনকে। রক্ষা করেনি জাতির জনকের ভাষ্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের মুর্যালকে, মুক্তিযুদ্ধের যাদুঘরকে। রক্ষা করেনি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
রক্ষা করেনি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। রক্ষা করেনি এদেশের নিরীহ মানুষকে। রক্ষা করেনি এদেশের পুলিশবাহিনীকে। রক্ষা করেনি থানাগুলোকে জঙ্গীদের আক্রমণ থেকে। রক্ষা করেনি এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান-মানুষকে।
রংপুরের পুরো একটি গ্রামে হিন্দুদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-ভেঙ্গে লুটপাট করা হলো নির্বিচারে। কই তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে যায়নি সেনাবাহিনী। লোক দেখানো কাজ করেছে।
গোপালগঞ্জে এনসিপির ‘ মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ ঘিরে সংঘটিত সংঘর্ষের সময় তারা সরাসরি এনসিপির পক্ষ নিয়েছে। প্রকাশ্যে গুলি করে পাখির মত মানুষ মেরেছে।
তাদের বুটের নীচে পিষ্ঠ হয়েছে মানবতা-মানুষ। তখন তাদের দেশরক্ষা-জনগণকে রক্ষা-সংবিধানকে রক্ষা করার সেই কোরআনী শপথ কই ছিল ?
সে প্রশ্ন যদি করে কেউ তখন কি জবাব দেবেন কর্মকর্তারা ? কিন্তু সেই সেনা কর্মকর্তারাই সম্প্রতি নির্লজ্জের মত দাবি করলেন- গোপালগঞ্জে ‘বলপ্রয়োগ’ হলেও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার হয়নি।
সম্প্রতি সেনাসদরের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের কাছে দাবি করলেন- “আমরা কোনো রাজনৈতিক দলকে বিশেষভাবে কখনো কাউকে সহায়তা করিনি। দায়িত্বের মধ্যে কাউকে বিশেষভাবে দেখি না,“ এনসিপির প্রতি সেনাবাহিনীর ‘আলাদা নজর’ থাকা প্রসঙ্গে জানালেন এক সেনা কর্মকর্তা।
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পদযাত্রা কর্মসূচি ঘিরে সংঘর্ষের সময় ‘জীবননাশের’ হুমকি তৈরি হলে ‘আত্মরক্ষার্থে’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ‘বল প্রয়োগ’ করলেও ‘প্রাণঘাতী’ অস্ত্র ব্যবহার হয়নি বলে দাবি করেছে সেনা সদস্য।
ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস পরিদপ্তরের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, “গোপালগঞ্জে একটি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি ছিল।
যেখানে শুধুমাত্র ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়নি ককটেলও নিক্ষেপ করা হয়েছে। “যখন সেখানে জীবননাশের হুমকি ছিল, তখন আত্মরক্ষার্থে আমাদের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ছিল তারা বল প্রয়োগ করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। এখানে প্রাণঘাতী কোনো অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়নি।”
সেনাবাহিনীর তরফে সাম্প্রতিক সময়ে যৌথবাহিনীর কার্যক্রম তুলে ধরতে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করা হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় এদিনের বিফ্রিংয়ে আসেন স্টাফ কর্নেল শফিকুল।
গোপালগঞ্জে গত ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কর্মসূচিতে দফায় দফায় হামলার পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে পুরো শহরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
সংঘর্ষের মধ্যে গুলিতে অনেকেই নিহত এবং অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক আহত হন। পরে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরেকজনের মৃত্যু হয়।
নিহতদের ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় ‘দুষ্কৃতকারীদের’ গুলিতে মৃত্যুর কথা বলা হলেও সেদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি চালাতে দেখার দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, শহরের গলির মুখে দাঁড়ানো হামলাকারীদের সরিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিক থেকে গুলি চালানো হয়।প্রশ্ন জাগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র থেকে যেসব সেনাসদস্যকে গুলি করতে দেখা গেছে সেখানে কি গুলির পরিবর্তে ‘গোলাপ ফুল’ ছিল?
আর সেই গোলাপ ফুলের আঘাতেই গোপালগঞ্জে ওইসব প্রাণহানি ঘটেছে ? এই হলো তাদের সংবিধান রক্ষা। এই হলো জনগণের নিরাপত্তা বিধান !
সবকিছু মিলিয়ে যা চলছে তাতে বলা যায় যে, সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কামান্ড কার্যকর নাই বা বলা যায় চেইন অব কমান্ড একদমই ভেঙ্গে গেছে। এটা গোপালগঞ্জের ঘটনার পরে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
সেনাবাহিনীর কথা, বার্তা, বসা, হাঁটা, অন্যের প্রতি ব্যবহার সব কিছুই চেইন অব কমান্ড মেনে। একজন জুনিয়র অফিসার দেশের পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রীকে কি ভাষায় কথা বলবেন, বা একজন রাজনীতিকের প্রতি তার ভাষার প্রটোকল অবশ্যই আছে। সেনাবাহিনীর সামনে খুব খারাপ সময় আসছে।
নিজ সংবিধানের প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ নেয়া সেনাবাহিনী এদেশের রাজনীতির পিছনে সবসময় কলকাঠি নাড়ার চেষ্টা করছে। এইবার প্রচুর পরিমাণে দেশদ্রোহী সেনাবাহিনীও দেখতে পাচ্ছি, যারা মূলত পাকিপন্থী।
আবার সেনাবাহিনীতে রক্তপাত অনিবার্য। কেউ ঠেকাতে পারবে না এই বিপুল রক্তক্ষয়। তবে সেটি দেশ ও জাতির জন্য নিশ্চয়ই মঙ্গল বয়ে আনবেনা। সেনাপ্রধান জনাব ওয়াকার- উজ- জামান, ইতিহাস আপনাকে একদিন যে প্রশ্নগুলো করবেই…
১. কেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি সংগঠনকে সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে ডাকার প্রয়োজন হয়েছিল?
২. আগস্টের ২-৪ তারিখে সেনা দরবারে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো গণমাধ্যমে বা বাইরের মহলে কীভাবে ফাঁস হলো?
৩. ধানমন্ডির ৩২ নম্বর, বীরশ্রেষ্ঠদের মুরাল ও মুক্তিযুদ্ধের স্মারকগুলো রক্ষা করতে সেনাবাহিনী ব্যর্থ হলো কেন?
৪. যারা প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে হুমকি দিয়েছে, অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি কেন?
৫. গোপালগঞ্জে সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালানোর নির্দেশ কে দিয়েছিল? এর দায়ভার কার?
৬. মব সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রোধে সেনাবাহিনী নীরব দর্শক হয়ে থাকল কেন?
৭. এনসিপি ও জামায়াতের মতো বিতর্কিত ও অগ্রহণযোগ্য গোষ্ঠীগুলো সেনা ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ ও সভা করার অনুমতি পেল কীভাবে?
৮. রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ- আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগকে যারা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কোনো দৃশ্যমান অবস্থান ছিলনা কেন?
রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার প্রচেষ্টাই তো চূড়ান্ত রাষ্ট্রদ্রোহ। ইতিহাস কি সেনাবাহিনীর এই নীরবতা ও সিদ্ধান্তহীনতাকে ক্ষমা করবে? শোধরানোর সময় আছে এখনো।
# নুরুল ইসলাম আনসারি, প্রাবন্ধিক, লেখক।