পুলিশ হেফাজতে থেকেও আইনজীবী হত্যা মামলার আসামী বাংলাদেশে সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী ! অবাক হলেও এটিই নির্মম বাস্তবতা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায়।

অনির্বাচিত-অগণতান্ত্রিক-অসাংবিধানিক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জামায়াত-হিযবুত তাহরীরসহ ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীর সমর্থিত সরকার পরিচালনার দায়িত্বে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন নেমে আসে। যা এখনো চলমান। গত বছরের ৫ আগষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের উচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর থেকেই সারাদেশেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার নির্যাতন।সেই অত্যাচার-নির্যাতনে অনেকেই ঘরবাড়ি ছাড়া, কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেঁচেছেন।

এমনতরো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন সনাতনী সংগঠন, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ করতে মাঠে নেমেছিলেন। তবে তাদের সেই প্রতিবাদ খুব বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। কারণ সরকার নানাভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বেশ কিছু নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এমনতরো পরিস্থিতিতে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন মঠ-মন্দিরের সাধু সন্নাসীরা রাজপথে নেমে আসতে বাধ্য হন।

ঢাকা-চট্টগ্রাম-রংপুর-ফরিদপুর-কুমিল্লা-বরিশালসহ বিভিন্ন স্থানে হিন্দুরা প্রতিবাদ বিক্ষোভে সরব হয়ে ওঠেন। সেই সাথে আন্তর্জাতিকভাবেও বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ করে ইউনুস সরকারের এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের তীব্র বিরোধীতা জানাতে থাকেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারির পুন্ডরিক ধামের প্রধান সাধু চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী নতুন করে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করেন।তার এই আন্দোলনে বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ হিন্দু সমাজ ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসে।

গত ২০২৪ এর সেপ্টেম্বর থেকে এই আন্দোলনের মাত্রা বেড়ে যাওয়াতে ইউনুস সরকার ও তার সহযোগীরা ভয় পেয়ে যায়। হিন্দুদের এই আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামীলীগ আবার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে খেপিয়ে তুলে একটি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে সরকারের পতন ঘটানোর মত পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে এমন আতংকে পেয়ে বসে তাদের। চট্টগ্রামে লালদীঘির ময়দানে হিন্দুদের সর্বকালের সর্ববৃহৎ সুশৃঙ্খল কিন্তু ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী জনসভা দেখে সরকার ভয় পেয়ে যায়। এই জনসভায় সনাতনী জাগরণ জোটের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দসহ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীও বক্তব্য রাখেন।এখান থেকেই পরবর্তীতে সারাদেশের বিভাগীয় শহরে সনাতনী জাগরন জোটের মহাসমাবেশ করাসহ নানা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ২০২৪ এর ২২ নভেম্বর রংপুরে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের নানা বাধা-হামলার পরও লাখ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী সমাবেশে যোগ দিয়ে তাদের অধিকারের কথা, প্রতিবাদের কথাগুলো জানায়। আর এতেই ভীত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ইউনূস সরকার।

রংপুর থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম ফেরার পথে গত ২৫ নভেম্বর ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ সনাতনী জাগরন জোটের মুখপাত্র চিন্ময় দাসকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে ( জাতীয় পতাকার অবমাননা) ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের একটি আদালতে হাজির করে পুলিশ। কথিত এই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীর জামিন নাকচ করে কারাগারে পাঠানোর আদেশের পর চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে প্রিজন ভ্যান ঘিরে ব্যাপক বিক্ষোভ করে সনাতন সম্প্রদায়ের লোকজন। আড়াই ঘণ্টা পর পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে চিন্ময় দাসকে কারাগারে নিয়ে যায়। সংঘর্ষের সময় বিক্ষোভকারীরা আদালত সড়কে রাখা বেশ কিছু মোটরসাইকেল ও যানবাহন ভাঙচুর করে। এরপর আদালতের সাধারণ আইনজীবী ও কর্মচারীরা মিলে তাদের ধাওয়া করে। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে রঙ্গম কনভেনশন হল সড়কে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ রহস্যজনকভাবে হত্যাকান্ডের শিকার হন। কিন্তু এই সময়টিতে চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী ছিলেন পুলিশের হেফাজতে। সহিংসতার ওই ঘটনায় সেদিন রাতেই তিনটি মামলা করে পুলিশ। আদালত প্রাঙ্গণ, রঙ্গম সিনেমা হল ও কোতোয়ালি মোড়ে তিন জায়গায় পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলাগুলো করা হয়।

এর মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনায় মামলায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৬০০/৭০০ জনকে, রঙ্গম সিনেমা হলের সামনের ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৩০০/৪০০ জনকে এবং কোতোয়ালি মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ২৫০/৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছিল।

চিন্ময়কে ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আদালত প্রাঙ্গনে এবং আশেপাশের এলাকায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে ‘বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মারধর, জখম, ভাঙচুর, লুটপাট, ক্ষতিসাধন, ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি কর্তব্য কাজে বাধা এবং অপরাধ মূলক বলপ্রয়োগের’ অভিযোগ আনা হয় এসব মামলায়। আইনজীবী আলিফকে হত্যার ঘটনায় ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন তার বাবা জামাল উদ্দিন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫/১৬ জনকে আসামি করা হয়। সেদিন আইনজীবীদের ওপর হামলা, বিস্ফোরণ ও ভাঙচুরের অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন আলিফের ভাই খানে আলম, যেখানে ১১৬ জনকে আসামি করা হয়।

এদিকে ১৮ মে রোববার চট্টগ্রামে চিন্ময় দাসের মামলার তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের শুনানি শেষে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দীনের আদালত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে দুইটি মামলায় জেল গেইটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী পিপি অ্যাডভোকেট মো. রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা এবং আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা আসামি চিন্ময় কৃষ্ণকে জেল গেইটে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন করেছিলেন। “এ বিষয়ে শুনানি শেষে আদালত ২ মামলাতেই একদিন করে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন।”

কিন্তু প্রশ্ন হলো — যে সময়টিতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হামলাকারিদের শিকার হন তখন বাংলাদেশে সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। তাহলে তিনি কি করে এই হত্যা মামলার আসামী হলেন ? বাংলাদেশের আইন-আদালত কোন পথে চলছে তা এই মামলার কিছু বিষয় পর্যবেক্ষণ করলে যে কোন সাধারণ বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিক বুঝতে পারবেন।

এর আগে গত ৬ মে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ২৬ নভেম্বরের ঘটনায় পুলিশের করা তিনটি মামলায় এবং আইনজীবী আলিফের ভাইয়ের করা একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। এর আগে ৫ মে তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদনের প্রেক্ষিতে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ দেয় আদালত। জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে করা একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার হন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। ওই মামলায় তাকে জামিন দেয় হাই কোর্ট। কিন্তু জামিন স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করলে তার মুক্তি আটকে যায়।

সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে ইউনূস সরকার হিন্দু সাধু চিন্ময় দাসসহ হিন্দু নীপিড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামেচ্ছু হিন্দু নাগরিকদেরকে চরমভাবে ভয় পাচ্ছে। নাহলে তাঁদের সভা সমাবেশের ওপর এত অত্যাচার নির্যাতন কেন ? আর পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার থাকা অবস্থায় একজন লোক কি করে হত্যা মামলার আসামী হয় তা দেখে সেই কথাটিই মনে পড়ে- উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ।

#নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, গবেষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *