নানা জল্পনা-কল্পনা ও সমালোচনা চলছে চট্টগ্রাম বন্দরে কোন বিদেশী অপরারেটরকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে। কিন্তু সে বিষয়ে কোন কিছুই বললেন না অনির্বাচিত-অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান প্রফেসর ড. ইউনুস।তবে তিনি বললেন, বন্দরের কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতা আরও বাড়াতে বিদেশিদের সম্পৃক্ত করার জন্য তিনি পরামর্শ দিয়েছেন।

বুধবার (১৪ মে) সকালে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে এসে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। তবে নানা সূত্র থেকে জানা গেছে মার্কিন মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠা নামার কাজ দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত।

বন্দর ব্যবহারকারি, শ্রমিক নেতা ও দেশপ্রেমিক রাজনীতি সচেতন নাগরিকগণ বলছেন- সেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’র মত ভারতবর্ষে ব্যবসার নাম করে পুরো ভারতই বৃটিশরা দখল করেছিল। এসেছিল ব্যবসার ছদ্মাবরণে। কিন্তু পরে দখলদার। নানা যুদ্ধ ভারতবাসীর সাথে। অতঃপর প্রায় ২০০ বছর পর বৃহত্তর ভারতকে ভাগ করে তারা বিদায় নিলো ঠিকই, কিন্তু হিংসার বীজ বপন করে গেলো।

আবার চট্টগ্রাম বন্দর ও ‘মানবিক করিডোর’ এর মাধ্যমে মার্কিনীরা একবার গেড়ে বসলে বাংলাদেশ আর নিজের স্বাধীন স্বত্তায় থাকবেনা।আওয়ামীলীগসহ কিছু কিছু প্রগতিশীল রাজনৈতিকদল বিচ্ছিণ্নভাবে ছদ্মাবরণে আমেরিকার আধিপত্য বিস্তারের ষড়যন্ত্রকে এখনই রুখে দেয়ার দাবি তুলেছে। তবে তা খুবই ক্ষীণ কন্ঠে। বাংলাদেশে একটি প্রবাদ আছে- ‘সূচ হয়ে ঢুকবে, ফাল হয়ে বের হবে।’ এই মার্কিন-ইজরাইল যৌথ ব্যবসায়ী মহল ঠিক তাই করতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে ঘিরে।

শিপিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা জানিয়েছেন, দুবাই ভিত্তিক কোম্পানী ‘ ডিপি-ওয়ার্ল্ড’ চট্টগ্রাম বন্দরে মূল অপারেটর হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছে।এটি মার্কিন এবং ইসরাইলী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত।বন্দরে এনসিটি ( নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল) পরিচালনার জন্য তাদেরকে দেয়া হলে মার্কিন নিরাপত্তাবাহিনী তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে অর্জিত লোকজনদের নিরাপত্তা দেয়ার জন্য বন্দরে মোতায়েন করার প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে শুথু এনসিটিই নয় সিসিটি (চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল)ও ওই কোম্পানীকে দেয়া হতে পারে।

তবে বুধবার ( ১৪ মে) প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরকে বাদ দিয়ে দেশের অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব নয়। বন্দরের কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতা আরও বাড়াতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিদেশিদের সম্পৃক্ত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। এটিকে বাদ দিয়ে অর্থনীতির নতুন পথ খোলা সম্ভব নয়।

বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে আগে শুধু লেখালেখি করেছি, এবার সুযোগ পেয়েছি নিজের চোখে দেখার এবং কাজ শুরু করার। এই বন্দর শুধু বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’

ড. ইউনূস বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথম দিন থেকেই চেষ্টা করছি এটিকে একটি সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের বন্দর হিসেবে গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের অর্থনীতি পাল্টাতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরই ভরসা। এই বন্দর চালু হলে বিদেশিরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে।’

চট্টগ্রাম বন্দরে একটি মাল্টিমিডিয়া ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করার পর প্রধান উপদেষ্টাসহ নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার শাখাওয়াত হোসেন ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়াল এডমিরাল মো. মুনিরুজ্জামান বক্তব্য রাখেন।

এদিকে কোন ধরনের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ছাড়াই কোন বিদেশী অপারেটরের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন অপারেশনাল কাজকর্ম ছেড়ে দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে দেশে নানা আলোচনা-সমালোচনা ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন- ড. ইউনুস যে কোন মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য মার্কিন মালিকানাধীর প্রতিষ্ঠান বা যারা তার নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য কাজ করবে তদেরকেই অপারেটর নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয় এখান থেকে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ হিসেবেও পাবেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালগুলো বিদেশি কোম্পানিকে পরিচালনার জন্য ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর মুহাম্মদ সিকান্দার খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিদেশি কোম্পানি যাদেরকে অপারেটর নিয়োগ দেয়া হবে তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, অতীত-বর্তমান রেকর্ড যাচাই করাটা অপরিহার্য। সবমিলিয়ে জনস্বার্থ ও দেশের স্বার্থ পূরণ করবে কিনা তা দেখতে হবে।

এ প্রসঙ্গে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল অপারেশন কার্যক্রম বিদেশি কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ অনেকেই পছন্দ করছেন না। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য আসছে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার মার্কিন কিংবা বিদেশি কারো স্বার্থে বন্দরকে দিয়ে দেবে না।

এ প্রসঙ্গে জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী শেখ নুরুল্লাহ বাহার বলেন, নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার পদক্ষেপ হবে আত্মঘাতী। বন্দরের নিজস্ব টাকায় এনসিটি নির্মিত এবং পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতিও কেনা হয়েছে। এটি বন্দরের স্বয়ংসম্পূর্ণ মূল স্থাপনা। প্রতিবছর কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, দক্ষতা, সক্ষমতায়, মুনাফায় রেকর্ড করছে। এনসিটিতে তো বিদেশিদের বিনিয়োগ করতে হচ্ছে না।

বিদেশিরা বে-টার্মিনালে বিনিয়োগ ও পরিচালনা করুক; আপত্তি নেই। ছয় গুণ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি সেখানেই করা যাবে। তাছাড়া এনসিটি নেভাল ঘাঁটিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহের লাগোয়া। এর সঙ্গে নিরাপত্তা ও স্পর্শকাতর দিক অবহেলা করা যায় না।

ইতিমধ্যে কিছু কিছু সংগঠন পৃথক সমাবেশ-বিক্ষোভ, সংবাদ সম্মেলন, সরকারের কাছে স্মারকলিপির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। তারা বলছেন, জাতীয় স্বার্থগত সবদিক গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বন্দরের টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে দেয়ার পদক্ষেপ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সরে আসাই হবে মঙ্গলজনক।

প্রসঙ্গত, ১৪ মে বন্দরের অনুষ্ঠান শেষে প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে যান। সেখানে সুধী সমাবেশ শেষে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাট সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর উন্মোচন করেন। দুপুরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ম সমাবর্তনে যোগ দেবেন। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টাকে ডি. লিট উপাধি প্রদান করা হয়।এরপর আর বিকেলে, দীর্ঘ ৮ বছর পর হাটহাজারীর বাথুয়ায় নিজ গ্রামের বাড়িতে যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

#নুরুল ইসলাম আনসারী, লেখক, গবেষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *