সহজে গদি ছাড়তে নারাজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।

বিএনপি বিরোধীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ দিয়ে আরও বেশ কিছুদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান উপদেষ্টারা। আর এটা বুঝে গিয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষ আমলারাও। তাই তাঁরা নিজেরাও ঢিলে দিচ্ছেন কাজকর্মে।

সরকারি কাজ লাটে উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রিয়তাও কমছে দ্রুত। গদি বাঁচাতে তাঁদের ভরসা এখন উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র আর মৌলবাদীরা। এছাড়াও পাকিস্তান বা তুরস্কের মতো বিদেশি শক্তির সঙ্গেও হাত মিলিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চান ইউনূস।

২০০৭ সালের তদারকি সরকারের মতোই চলছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাঁরা যে বিপদে পড়বেন, সেটা ভালোই বুঝেছেন ইউনূসরা। তাই গদি আগলে রাখতে বদ্ধপরিকর তাঁরা।

জামায়াত বা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সব বুঝেও এখন নীরব দর্শক। কারণ তারাও চাইছে অন্তর্বর্তী সরকারের ছায়া নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশ্রয়েই দেশজুড়ে ‘মব সন্ত্রাস’ চালাচ্ছেন এনসিপি নেতারা। তাঁদের সমানে মদদ দিচ্ছে জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামিক ছাত্র শিবির। বাংলাদেশে শরিয়ত আইন চালুর এটিও একটি কৌশল।

তাঁদের এই কৌশল প্রতিহত করার জন্য সেনাবাহিনী ছাড়া আর কেউ এখন মাঠে নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার ফলে সচিব থেকে শুরু করে সরকারি আমলাদের সকলেরই মনোবল তলানিতে এসে ঠেকেছে।

কাল কী হবে কেউ জানে না, তাই দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে আইনের শাসন। পুলিশ ও প্রশাসন এখন এই অস্থির সময়ে নিজেদের চাকরি বাঁচাতেই ব্যস্ত।

হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশে মাজার, বাউল আখড়া, আদিবাসী ও ভিন্নমতের মানুষদের ওপর হামলা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও ম্যুরাল ভাঙার মতো ঘটনায় একটি ভয়াবহ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

মব সংস্কৃতি সাধারণ মানুষকে করে তুলেছে আতঙ্কিত। এমনিতেই দেশে জিনিষের দাম আকাশছোঁয়া। টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকছে। বাড়ছে দারিদ্রতা, চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি, চাঁদাবাজি।

সবমিলিয়ে এক বছরেই অন্তর্বর্তী সরকারের জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ‘মব সন্ত্রাস’-এর দোহাই দিয়ে জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল শুরু করে দিয়েছে।

জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোর নেতারা বলছেন, ‘মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে- এমন পরিবেশ নেই’। তাদের মতে, ‘পুলিশ ও প্রশাসন এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে’।

জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসসহ অন্যরাও। ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, ‘যেনতেন নির্বাচন হয়ে লাভ কী’!

আসলে তাঁরা কেউই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চান না। কারণ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপির জয় নিশ্চিত। তাই তাঁরা ইউনূসকে ক্ষমতায় রেখে নিজেদের জয় সুনিশ্চিত করতে চাইছে।
বিএনপি সেটা বুঝতে পেরেছে।

বিএনপির চেয়ারপার্সন তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশে দ্রুত গণতন্ত্র ফেরাতে হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও একই দাবি করে চলেছেন।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের যে ভোট নিয়ে সদিচ্ছা নেই সেটা বুঝতে পেরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ফের বলেছেন, ‘দেশের মঙ্গলের জন্যই দেশকে দ্রুত নির্বাচনের ট্র্যাকে ওঠাতে হবে’।

কিন্তু সেই ট্র্যাকে ওঠার কোনও লক্ষণ নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, তাঁরা ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু কোনও রোড ম্যাপ তিনি এখনও জানাননি।

আসলে সংস্কার আর বিচারের নামে জামায়াত ও এনসিপির চাপে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা শুরু করে দিয়েছে।

তাই বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেছেন, ‘নানা সংস্কারের কথা বলে নির্বাচন পেছানোর যে ষড়যন্ত্র সেটা করতে দেওয়া হবে না। এদেশের খেটে-খাওয়া মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে এদেশে কারা ক্ষমতায় আসবে, কে এমপি হবে, কে মন্ত্রী হবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আরও একধাপ এগিয়ে বলছেন, ‘বিএনপি সংস্কার চায়, কুসংস্কার নয়’।

কিন্তু এনসিপি কিছুতেই ভোট চাইছে না। কারণ তাঁরা জানে এখন নির্বাচন হলে সব আসনে প্রার্থী দেওয়াই তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হবে। দিন দিন কমছে তাঁদের জনসংর্থন।

বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে, বিএনপি তো বটেই আওয়ামী লীগের থেকেও তাঁদের জনপ্রিয়তা এখন অনেক কম। ইসলামী বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনকে সঙ্গে নিলেও জামায়তেরও পরাজয় নিশ্চিত। তাই ভোটে যেতে তাঁরা নারাজ।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নির্বাচনের বদলে দেশ গড়ার কথা বলছেন। তাঁর মতে, ‘দেশকে নতুন করে গড়ে তোলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এনসিপি বাংলাদেশকে নতুন করে গড়ে তুলবে।’

অনেকেই মনে করেন, এনসিপি মাঠ দখলের কৌশল হিসাবেই মব সংস্কৃতি চালু করেছে। মজার কথা, তাঁদের এই মব সন্ত্রাসকে সমর্থন করছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানও।

তাঁর সাফাই, ‘মব সর্বকালে বাংলাদেশে ছিল, এটা ৭২ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। এবং এখন পর্যন্ত এটা কন্টিনিউ করছে’। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলছেন,‘দেশে এই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কিসের? কি নির্বাচন হবে? এ জন্য আগে নির্বাচনের পরিবেশ অবশ্যই তৈরি করতে হবে।’

সেইসঙ্গে তাঁর হুমকি, ‘নতুন পুরাতন বুঝি না, আগামীতে যেকোনো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সবাইকে আগামীর লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সে লড়াইয়ে কোরআন বুকে নিয়ে আমরাই জিতব ইনশাল্লাহ।’

নির্বাচনের বিরোধিতা করেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ তাহের বলেছেন, ‘বিএনপি ধরে নিয়েছে এবার তারাই ক্ষমতায় যাবে আর ক্ষমতায় গিয়ে আগের মতো অপকর্ম করবে।’

সোজা কথায়, জামায়াত বা এনসিপি নির্বাচন চাইছে না। অন্তর্বর্তী সরকারেরও নির্বাচন নিয়ে খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। বিনা নির্বাচনেই দিব্যি তাঁরা সরকারি ক্ষমতা ভোগ করছেন। এই সুযোগ ছাড়তে তাঁরা নারাজ।

লন্ডনে ইউনূস ভোটের কথা বলে এলেও তিনিও এখন নীরব। আর তাঁর সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলছেন ‘আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি নির্বাচনের আগে ফ্যাসিস্টদের অবশ্যই বিচার হবে। সংস্কারও করতে হবে’।

এতেই বোঝা যায়, সংস্কারের নাম করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে স্থগিত করতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। তাঁরা চায় না জনগণের রায়কে মাথা পেতে নিয়ে বিএনপি ভোটে জিতে সরকার গড়ুক।

এক বছরেই ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার পর নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কিছুতেই চাইছেন না উপদেষ্টারা। তাই জামায়াত ও এনসিপিকে খুশি রাখতেই তাঁরা ব্যস্ত। দেশ ভুগছে চূড়ান্ত অস্থিরতায়। সমস্যায় পড়ছেন দেশের সাধারণ মানুষ।

#আনোয়ার হুসেইন

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *