আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে সাফাই গেয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি) কি তাদের পিঠ বাঁচাতে চাইছে এমন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। অথচ বেশ কিছুদিন আগেও ( জাতীয় নাগরিক পার্টি) এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে যখন আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছিল তখন বিএনপি এর বিরোধিতা করেছিল।

অথচ গত ১০ মে রাতে এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য কিছু চরমপন্থী ইসলামী দলের দাবির মুখে ( ইউনুস সরকারের পূর্ব পরিকল্পিত প্ল্যান অনুযায়ী) সরকার যখন আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো তারপরই বিএনপির সুর পাল্টে গেলো। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এটি বিএনপির রাজনীতির জন্যই একটি অত্যন্ত খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়ালো।

বিএনপি হয়তো মনে করছে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার ফলে আগামী নির্বাচনে তারাই ক্ষমতায় আসবে অবধারিতভাবে। কিন্তু সেটি হয়তো তাদের জন্য উল্টো ফল হতে পারে। জামাত, এনসিপি, চরমপন্থী ইসলামী দলগুলো অদূর ভবিষ্যতে যে বিএনপিকেও নিষিদ্ধ করার দাবি তুলবেনা তার কোন গ্যরান্টি কিন্তু নেই বর্তমান বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অরাজকতা চলছে এর মধ্য দিয়ে।

গত বছরের ৫ আগষ্ট দেশি-বিদেশী চক্রান্তে আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করার পর পরই লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যে ভিডিও বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাতে মনে হয়েছিল তিনি হয়তে অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশে আসবেন এবং তিনিই প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।

তারেক রহমানের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, বক্তব্য এবং বিএনপি নেতা কর্মীদের হাবভাবে তেমনটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির মারপ্যাঁচ ও বাংলাদেশের রাজনীতির নাটাই যে বাংলাদেশে নেই তা হয়তো তারা বুঝতে পারেনি। গত জুলাই-আগষ্টে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী বিরোধী ষড়যন্ত্রে আওয়ামী সরকারের পতন হওয়ার দীর্ঘ সাড়ে ৯ মাস হতে চললো কিন্তু বিএনপি’র মহাশক্তিধর নেতা তারেক রহমান এখনো বাংলাদেশে আসেননি। এরমধ্যে তার মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া লন্ডনে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি চিকিৎসাও নিয়েছেন। এরই মধ্যে বেগম জিয়া তার দুই পুত্রবধুসহ দেশেও ফিরে এসেছেন।

এই দুই পুত্রবধূ নাকি বিএনপির রাজনীতিতেও সক্রিয় হচ্ছেন এমনটাই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও দুই পুত্রবধূর মধ্যে বিরোধ রয়েছে বলেই জানা গেছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মার্কিন চাপ আগের চেয়ে অনেকগুণ যে বেড়ে গেছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। উড়ে এসে জুড়ে বসা অন্তবর্তীকালীন সরকার প্রধান নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনুস, তাঁর পারিষদবর্গসহ সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, জামায়াতে ইসলামী, কথিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের নবগঠিত ( কেউ কেউ এটিকে টোকাইদের দল বলে থাকেন ঘৃনাভরে) এনসিপি এমনকি বিএনপিও তা বুঝে গেছে। এদের সবাইকে নানাভাবেই মার্কিনীরা বশে রেখেছে।

এখন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কে বা কোন দল কার চেয়ে বেশি তোষামদি ও জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর করে সেই মার্কিনীদের খুশি করতে কে প্রথম হবে সে প্রতিযোগিতা। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মত মার্কিন একটি প্রতিষ্ঠান ঢুকে গেছে। আর সেই প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দেখভাল করার জন্য আসবে মার্কিন প্রতিরক্ষা টীম।

ওদিকে কক্সবাজার বান্দরবান সীমান্ত এলাকা দিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ‘ মানবিক করিডোর’ এর ছদ্মাবরণে জাতিসংঘের ব্যানারেও ঢুকবে মার্কিন সেনাদল। রাখাইনসহ বাংলাদেশের কিছু অংশ এমনকি ভারতের মিজোরামের কিছু অংশ মিলে আয়তনে ছোট কিন্তু কার্যত: একটি শক্তিশালী মার্কিন ঘাঁটি তৈরী হওয়ার সব প্রচেষ্টাই চলছে। বাংলাদেশের অথর্ব ইউনুস সরকারতো কথিত এই মানবিক করিডোর জাতিসংঘের নামে মর্কিনীরা চাওয়ার আগেই সম্মতি দিয়ে বসে আছে। অথচ রাখাইন প্রদেশে মানবিক সাহায্য নিয়ে যাওয়ার জন্য সেখানেই সমুদ্র বন্দর রয়েছে। তাহলে জাতিসংঘ সেখান দিয়ে সাহায্য না পাঠিয়ে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে কেন ‘ মানবিক করিডোর’ তৈরী করে নিলো ? বাহ্ ! কি সুন্দর নাম – “ মানবিক করিডোর”!

এই করিডোর নিয়ে কিন্তু আলোচিত দলগুলোর কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কারন তারাতো নিজেদের অবস্থানকে ‘ জ্বী হুজুর’ মার্কা করে ফেলেছে ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং ক্ষমতায় যেতে। এই করিডোরের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কক্সবাজার, বান্দরবানের বেশ কিছু অংশ, বঙ্গোপসাগরের সেন্টমার্টিনস দ্বীপ, মহেশখালীর গভীর সমুদ্র বন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দরও জাতিসংঘের ছদ্মাবরনে মূলত মার্কিনীদের হাতে যাওয়ার আশংকা রয়েছে তা এসব রাজনৈতিক দল বা বর্তমান সরকারের অজানা নয়।

কিন্তু এক্ষেত্রে তারা ‘ স্পিকটি নট’ অবস্থানে রয়েছে। তবে এই করিডোর নিয়ে রাখাইন প্রদেশের প্রতিবেশি ভারত, চীন কি চুপচাপ বসে থাকবে ? অপরদিকে রাশিয়াও কি চাইবে এ অঞ্চলে মার্কিন অধিপত্য ? তাহলে এ নিয়েতো ঝগড়া-ফ্যাসাদ বেধে যেতে খুব বেশি দেরি হবেনা। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের এইে বাংলাদেশ।

একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবেনা যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাহাযার্থে তারা তাদের সপ্তম নৌ বহরকেও বাংলাদেশ অভিমুখে যাত্রা করিয়েছিল। তখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আরেক পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিনীদেরকে সপ্তম নৌবহর সরিয়ে নিতে হুমকি দিয়ে বলেছিল যে , অতিদ্রুত তারা যদি বাংলাদেশমুখী সপ্তম নৌ বহরের যাত্রা বাতিল না করে তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নও শক্তিশালী নৌবহর পাঠাবে।

অবশেষে সেই হুমকিতে সপ্তম নৌবহর আর আসতে পারেনি। তাহলে এবারো যে জাতিসংঘের নামে ‘ মানবিক করিডোর’ এর আড়ালে মূলত মার্কিনীরাই ঢুকতে চাইছে এ অঞ্চলে তা নিশ্চয়ই বিনা চ্যালেঞ্জে হবেনা। আর তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশ কি সামরিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বেনা ? এরই মধ্যে মার্কিনীদের নানা তৎপরতা থেকে এদেশের মানুষের দৃষ্টি সরাতে আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট এর ব্যাংকক যাত্রা, নারায়ণগঞ্জের সাবেক জনপ্রিয় মেয়র ও আওয়ামীলীগ নেত্রী ডা. সেলিনা হায়াত আইভি’র গ্রেপ্তার ও সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের নানা নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করছেন এদেশের দেশপ্রেমিক রাজনীতি সচেতন জনগণ ও বিশ্লেষকগণ।

একটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার যে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে বরাবরই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা রেখেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন সোভিয়েত ব্লক ও মার্কিন ব্লক এই দুই ব্লকের বাইরে গিয়ে ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুগোস্লোভিয়ার প্রেসিডেন্ট মাশাল টিটোসহ বিশ্বের আরো অনেক রাষ্ট্র নায়কদের সমন্বয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় বলেছিলেন-‘ চিলির আলেন্দের মত রক্তে লাল হয়ে যাবো, তবু সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করবোনা।’

সত্যিই তাই। তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত করেননি। কিন্তু একাত্তরের সেই পরাজিত শক্তি পাকিস্তান ও আমেরিকার গভীর ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট তাঁকে সপরিবারে প্রাণ দিতে হলো। তিনি পাকিস্থান আমলেই ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ এর নাম থেকে সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ জনগনের রাজনৈতিক দল তৈরী করতে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগ করার সাহস দেখাতে পেরেছিলেন।

যে স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাসহ আপামর জনগণ যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল পাকবাহিনীর কবল থেকে সেই আওয়ামীলীগকেই এই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো একটি অনির্বাচিত-অগণতান্ত্রিক অবৈধ সরকার। আর এর পেছনে মদদ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, হিযবুত তাহরীরসহ আরো কয়েকটি চরমপন্থী ইসলামী দল। বিএনপি তাতে সমর্থন দিয়েছে লিখিতভাবে বিবৃতি দিয়ে।

অথচ বিএনপি দাবি করে তাদের দলে প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান। কয়েকদিন পরে যদি বিএনপিকেই নিষিদ্ধ করা হয় তখন তারা কি করবে তা কি ভেবে দেখেছেন এই দলের নেতারা ?

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাঁর শরীরে যেমন বঙ্গবন্ধুর রক্তের স্রোত বইছে তেমনি সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথা নত না করা এক অসীম সাহসী রাজনৈতিক বীরের নীতি-আদর্শও বহমান অন্তরে। শুধু অন্তরে নয় তার কর্মেও তিনি তাঁর প্রমাণ রেখেছেন। তিনি কারো পরিচয় উল্লেখ না করে নিজে এমনটি বলেছেন- তাঁর কাছে সাদা চামড়ার এক মানুষ এসেছিল কিছু প্রস্তাব নিয়ে, তার মধ্যে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপসহ কিছু ব্যাপারে মার্কিনীদের ছাড় দিতে হবে। তাহলে তিনি যতদিন খুশী ততদিন বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।

পাশাপাশি তিনি প্রকাশ্যে এমন অভিযোগও করেছিলেন যে- পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের কিছু অংশ, মিজোরাম ও মিয়ানমারের কিছু অংশ নিয়ে একটি খ্রীষ্টান রাষ্ট্র গঠন করার ষড়যন্ত্র চলছে।

এই যে মার্কিনীদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়া এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তিনি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিলেন সেই মাশুল দিতে হয়েছে তাঁকে চরমভাবে কথিত আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত ও দেশত্যাগে বাধ্য করে। শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে স্পষ্ট করেই বলেছেন- “ শেখ হাসিনা জাতির জনকের মেয়ে, শেখ হাসিনা কখনো দেশ বিক্রি করেনা। তিনি বলেছেন-আওয়ামীলীগ জনগণের অধিকার আদায় ও অধিকার প্রতিষ্ঠার দল।”

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে- তাই মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারি দল আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করলেই সে দলটির কর্মকান্ড বন্ধ হয়ে যাবে তা কিন্তু নয়। এরই মধ্যে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী আওয়ামীলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর  উদ্দেশ্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন- “ কথিত মানবিক করিডোর দেওয়া হলে মহাবিপদে পড়বে বাংলাদেশ। বর্তমান অবৈধ ইউনুস সরকারের লক্ষ্য একটাই, নির্বাচন না দেওয়ার ধান্ধা।” এসবের বিরুদ্ধে তিনি আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে সজাগ ও লড়াই সংগ্রামের প্রস্তুতি নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন।

#রাকীব হুসেইন, লেখক, গবেষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *