বাংলাদেশের গোটা বিচার ব্যবস্থাটাই প্রহসনে পরিণত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমলে বিচার তো দূরঅস্ত, স্বাধীনভাবে কথা বলারই জো নেই। বিচার ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করার স্বার্থেই পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে রাজসাক্ষী করা হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মতো তিনিও মিথ্যামামলায় অভিযুক্ত। তবে ১০ জুলাই ট্রাইব্যুনালে হাসিনা ও আসাদুজ্জামানকে ‘পলাতক’ দেখানোর পাশাপাশি ধৃত সাবেক আইজিপিকে রাজসাক্ষী হিসাবে দেখানো হয়।
আইনজীবীদের মতে, হাসিনাদের দোষী সাব্যস্ত করার জন্যই তাঁকে রাজসাক্ষী হতে বাধ্য করা হয়েছে। গোটা বিচার ব্যবস্থাটাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সমর্থকদের ইচ্ছাতেই চলছে।
তাঁদের মর্জিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মামুনকে রাজসাক্ষী করে হাসিনাদের দোষী প্রমাণে মরিয়া।
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক প্রধান মামুন গ্রেপ্তারের পর তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁকে রাজসাক্ষী করে হাসিনাদের দোষী সাব্যস্ত করার ফাঁদ পাতা হয়েছে।
মুখ্য সরকারি আইনজীবী তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, অভিযুক্ত মামুন অপরাধের বিষয়ে তথ্য দিয়ে ট্রাইবুনালকে সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছেন। আর মামুন বলেছেন, ‘জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলাম, সব রহস্য উন্মোচন করব। এই মামলায় আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাজসাক্ষী হতে চাই।’
তবু তিনি জেল থেকে মুক্তি পাননি। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, ‘নিরপত্তার জন্য কারাগারে একক সেলে নেয়া হয়েছে তাঁকে’।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে বাংলাদেশে। অন্য একটি মামলাতেও গুম-খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাঁকে।
ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগেরও মামলা আছে তাঁদের বিরুদ্ধে। শুধু একটি মামলায় মামুন রাজসাক্ষী।
বাংলাদেশের সংবিধানে রাজসাক্ষী হয়ে সহজে কারও মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। সাক্ষ্য আইনের ১৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, অপরাধীকে অবশ্যই অন্য অপরাধীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদানে সক্ষম হতে হবে। তবে শুধুমাত্র অপরাধ সহযোগীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া যাবে না।
আইনটি খুবই জটিল। তাই সহজে কেউ রাজসাক্ষী হতে রাজি হওয়ার কথাও নয়। পুলিশের সাবেক প্রধানের আইনটি অবশ্যই জানা আছে।
বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইনের ১৪৪ ধারা অনুযায়ী রাজসাক্ষীর একক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে শাস্তি প্রদান করা যাবে না। কারণ সহযোগী অপরাধীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টিও আদালতকে মাথায় রাখতে হয়।
তাই একজন বিশ্বাসঘাতক সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের সময় বিশেষ সতকর্তা অবলম্বন জরুরি। তবু শুধুমাত্র সাক্ষ্যের অভাবে কোনো অপরাধী যাতে ছাড় না পান তারজন্য ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় শর্তসাপেক্ষে আসামিকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করার বিধান রয়েছে।
ফৌজদারি আইনের ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৩৩৯ ধারায় দুষ্কর্মের সহচরকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়টিরও উল্লেখ রয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট, ১৯৭৩-এর ১৫ ধারায় এ ধরনের সাক্ষীর বিষয়ে বলা হয়েছে, জ্ঞাত সব পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ ও সত্য প্রকাশের শর্তে স্বীকারোক্তি দেন, তাহলে ট্রাইব্যুনাল রাজসাক্ষীকে ক্ষমা করতে পারে।
অর্ধ শতাধিক রাজসাক্ষী প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটরিয়াল উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী স্বীকার করেছেন,‘প্রতিটি ফৌজদারি মামলা স্বাধীন পুলিশ প্রতিবেদন ও বিচারকালে স্বাধীনভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় চলে।
ট্রাইব্যুনালের মামলায় রাজসাক্ষী হওয়ার কারণে অন্য কোনো মামলায় এ সুবিধা পাওয়ার আইনগত কোনো সুযোগ নেই।’ তাই সন্দেহ আরও বাড়ছে।
আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর বিচারের কাজে যেভাবে সরকার নাক গলিয়েছে তাতে করে সন্দেহ আরও প্রকট হয়েছে। ইচ্ছা মতো বিচারপতিদের অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে। হাইকোর্টের বিচারপতিরা অতীতের রায় বদলাতে বাধ্য হয়েছেন।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সরকারের অপছন্দের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাংবাদিক, অধ্যাপক, গবেষক, লেখক, শিল্পী কেউই ছাড় পাচ্ছেন না। মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও হয়রানি বর্তমান সরকারের কৌশল হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত সভাপতি ও সম্পাদক অপরাধ ছাড়াই জেল খাটছেন।
খুনের মামলা করা হয়েছে প্রেস ক্লাবের বর্তমান সম্পাদক আয়ুব ভূইঞার বিরুদ্ধেও।
বাংলাদেশের আইনজীবীরাও সাধারণ মানুষের মতো আস্থা হারাচ্ছেন বিচারব্যবস্থার ওপর। তাই বাড়ছে মবসন্ত্রাস। এই অবস্থায় শেখ হাসিনা ও তাঁর দলবলকে বিচারের নামে শাস্তি দিতে গিয়ে গোটা দেশেরই বিচারব্যবস্থাকে লাটে তুলছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গণঅভ্যুত্থানের মোড়কে সরকার গঠিত হলেও গণতান্ত্রিক প্রতিটি কাঠামোর মতো বিচারব্যবস্থারও কবরস্থান হয়ে উঠছে বাংলাদেশ।
#আনোয়ার হুসেইন