বাংলাদেশে সনাতন বা হিন্দু ধর্মবলম্বীদেরকে মুসলিমরা ‘ মালাউন’ বলে গালি দেয়। এই গালিটি গত বছরের অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পর থেকে আরো বেশি করে ব্যবহৃত হচ্ছে। পথে-ঘাটে-অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সব জায়গাতেই এর অপব্যবহার বেড়েছে। কথায় কথায় মালাউন বা মালাউনের বাচ্চা বলে গালি দেয়া যেন একটি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এ নিয়ে মনে প্রচন্ড কষ্ট পেলেও হিন্দুরা কিন্তু মুখ ফুটে কোন প্রতিবাদ করতে পারছেনা। কারণ জীবন যেখানে হুমকিতে সেখানে কে আর এসব নিয়ে প্রতিবাদ করে পৈত্রিক প্রাণটা হারাতে চায় বলুন ?
গত ৫ আগষ্টের পরেই যে শুধু এই ‘ মালাউন’ বলে গালি দেয়া হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আগেও ছিল। তবে তা এতটা প্রকট ছিলনা। কারণ তখন কিছুটা হলেও চক্ষুলজ্জা কাজ করতো। কিন্তু সেই লজ্জার পর্দা কেটে গেছে যেন ৫ আগষ্টে সরকার পরিবর্তনের পর থেকে।
কোন সংখ্যাগত পরিসংখ্যানে ভারাক্রান্ত না হয়েও এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশে ক্রমাগতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে নানা কৌশলে দেশছাড়া করার প্রক্রিয়াটি চলমান থাকবেই। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক দলই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ন্যায্য নাগরিকত্ব দেয়নি। তা সে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারি আওয়ামীলীগ বলুন আর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ( বিএনপি), জাতীয় পার্টি’র কথাই বলুন। কারণ সেই যে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হলো। হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান। যদিও কথা ছিল হিন্দুস্তান বা ভারত হবে হিন্দুদের আবাসভূমি আর পাকিস্তান হবে মুসলিমদের।
অথচ ব্রিটিশ-ভারত-পাকিস্তানের তৎকালীন নোংরা রাজনৈতিক চালে ভারতের দুই দিকে প্রায় এক হাজার মাইল দূরে দুটি পাকিস্তান-পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। কিন্তু সেই হিন্দুস্তান বা ভারতেও শুধু হিন্দুরা নয় অনেক মুসলিমসহ নানা ধর্মের মানুষের বসবাস। আবার দুই পাকিস্তানেও একই অবস্থা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নানামুখী শোষন-অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হলো। সবাই আশা করেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শাষনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সব ধর্মের ও জাতির নাগরিকরা সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু সেই স্বপ্নভগ্ন হতে বেশিদিন লাগেনি।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ( দুই কন্যা বিদেশে থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান) হত্যার পর থেকেই বাংলাদেশ আবার সেই পাকিস্তানী ভাবধারায় পেছনের দিকে চলতে শুরু করে। যে ভারত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এত ত্যাগ স্বীকার করলো, সাহায্য দিলো, এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিলো, নিজেদের কয়েক হাজার বীর সৈনিক হারালো সেই ভারতকেই শত্রু ভাবা শুরু হলো। একাত্তরের পরাজিত শক্তিরা ( জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানের দোসররা) বাংলাদেশের নাগরিকদের মনে অত্যন্ত সুকৌশলে ভারত বিদ্বেষ-হিন্দু বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
আর সেই ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় অধিকাংশ হিন্দুদেরকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের অনেকের সম্পত্তিই ‘ শত্রু সম্পত্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হলো। শুধু তাই নয় সেসব সম্পত্তি পাকিস্তান সরকার অধিগ্রহণ কর নিলো। মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। হিন্দুদের আশা ছিল ‘ শত্রু সম্পত্তি’র অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন তারা। কিন্তু না সে আশায় ছাই পড়লো। আশাভঙ্গ হলো। বঙ্গবন্ধুর আমলেও সে শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল হলোনা। পচাত্তরের পরে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান নানা কৌশলে ক্ষমতায় বসে সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতাকে কুঠারাঘাত করে সংবিধানের ওপরে বসালেন ‘ বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’।
তারপর আরেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ এলেন ক্ষমতায়। তিনিও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে খতনা করিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করলেন। কিন্তু রাষ্ট্র কি কোন ধর্ম পালন করে ?
সেই যে ১৯৭৫ এর পর থেকে বাংলাদেশের হিন্দুদেরকে নানাভাবে অত্যাচার নির্যাতন করে দেশত্যাগে বাধ্য করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা কিন্তু কখনো থেমে ছিলনা। কখনো কম , আবার কখনো বেশি-এই যা পার্থক্য। তবে ২০২৪ সালের আগে ১৫ বছর এই অত্যাচার নির্যাতন কিছুটা কম ছিল। নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পদে হিন্দুরা নিয়োগ পেয়েছিল। যা কারো দয়া দাক্ষিণ্যের বিষয় ছিলনা মোটেই।
অথচ সেই শত্রু সম্পত্তি ( যা পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি নাম দিয়েছিল আওয়ামীলীগ সরকার) কিন্তু বাতিল হয়নি। নানা আইনী মারপ্যাঁচে তা রেখে দেয়া হয়েছে। তারমানে এদেশে হিন্দুরা সেই যে ১৯৬৫ সালে ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল তা এখনো বহাল রয়েছে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও।
আর ২০২৪ এর ৫ আগষ্টের পর থেকে তো বাংলাদেশটি আবার যেনো সেই পাকিস্তানেই ফিরে গেছে। হিন্দুদের ওপর নেমে এলো অকথ্য নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, হামলা-মামলা, নারী নির্যাতন, ধর্ষন, ঘরবাড়ি, ব্যবসা বাণিজ্য, জায়গা জমি দখল ইত্যাদি। হিন্দুরা যেনো এই দেশের শত্রু। সেইসাথে চরম ভারত বিরোধীতা। আর পাকিস্তানের সাথে চরম বন্ধুত্ব।
পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর পরামর্শেই যেনো চলছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অনেক হিন্দু নেতা, সাধু এখন কারাগারে। ৫ আগষ্টের পরে দেশব্যাপী সংঘটিত হিন্দু নির্যাতনের প্রতিবাদকারি ধর্মীয় নেতা সাধু চিন্ময় দাসসহ আরো অনেককেই মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে পুরে রাখা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ সারাদেশে অন্তত শতাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নানা হয়রানিমূলক মামলা দেয়া হয়েছে। কাউকে কাউকে জেলে আটক রাখা হয়েছে।
একটি জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারন সম্পাদক শ্যামল দত্তকে মাসের পর মাস জেলে রাখা হয়েছে। হিন্দুরা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারছেন না।
বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের নেতা ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর প্রথম বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯২ সালে, ভারতে বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেবার সময়। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। এরপর হিন্দুদের ওপর বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবার পরে।
নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করার পরপরই দেশের বেশ কিছু জেলায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়। যদিও তখন ক্ষমতায় ছিল বিচারপতি লতিফুর রহমানে নেতৃত্বে তত্ত¡াবধায়ক সরকার। নির্বাচনে ফলাফল প্রকাশের দিন থেকে শুরু করে বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে। এছাড়া বিএনপি ক্ষমতা গ্রহণ করার পরেও বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল। এসবের পেছনে বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। সর্বশেষ হিন্দুদের ওপর হামলার অভিযোগ আসে গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ এর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পরে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বিভিন্ন সময়েই বলেছেন , হিন্দুদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে এক ধরণের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। এসব হামলার সাথে যারা জড়িত ছিল অতীতে তাদের বিচার কখনো হয়নি। ফলে এটি থামানো যাচ্ছে না। তার মতে-তারাই হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা ধর্মীয় সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন না।”
তিনি বলেন এই ধারা পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে। কয়েকমাস আগে বিবিসি বাংলার সাংবাদিকের সাথে এক সাক্ষাতকারে রানা দাশগুপ্ত বলেছেন- গত ১৫ বছর যাবত আওয়ামী লীগ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদন্নোতির ক্ষেত্রে ‘অতীতের বৈষম্য’ দূর করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অনুপাত মোট জনসংখ্যার আট শতাংশ। কিন্তু সে অনুপাতে নিয়োগ ও পদোন্নতি হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। “যখন সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন চাকরিক্ষেত্রে দেখা গেল, তখন আবার কেউ কেউ চিৎকার শুরু করলো যে সংখ্যালঘুরা তো সব খেয়ে ফেলছে।”
২০২৪ এর ৫ আগষ্টের পরবর্তী হিন্দু নির্যাতনকে বর্তমান ইউনূস সরকার বার বার দাবি করেছে এগুলো রাজনৈতিক সহিংসতা। কিন্তু এর বিরোধীতা করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, বিষয়টিকে শুধু রাজনৈতিক মাত্রা দেবার সুযোগ নেই। চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি কি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন? তাহলে তাঁর বাড়ি কেন গুড়িয়ে দেয়া হলো?” প্রশ্ন তোলেন রানা দাশগুপ্ত।
প্রসঙ্গত: ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন ও মানবতা-বিরোধী কর্মকান্ডের অভিযোগ অনুসন্ধানে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেটির চেয়ারম্যান ছিলেন ছিলেন, মো. সাহাবউদ্দিন, যিনি বর্তমানে রাষ্ট্রপতি। সাহাবউদ্দিন কমিশন ২৫ হাজারের মতো অভিযোগ পেলেও তারা যাচাই-বাছাই করে পাঁচ হাজার অভিযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সেগুলোর কোন বিচারও হয়নি বলে জানাচ্ছেন হিন্দু নেতারা।
লেখাটির প্রথমেই যে ‘ মালাউন শব্দটির ব্যবহার করেছিলাম সেটি ইসলামী ভাষায় অর্থ হলো ‘ আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত’। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অভিধানে ‘ মালাউন’ শব্দের বাংলা অর্থ দেওয়া হয়েছে ‘ আল্লাহর রহমত থেকে অভিশপ্ত বা বঞ্চিত’ বা ‘ কোর পূর্বক উচ্ছেদকৃত’ বা ‘ কাফির’। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে আমাদের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে কোন বার্তা রয়েছে হিন্দুদেও সম্পর্কে। অথচ এই বাংলাদেশটি স্বাধীন হয়েছিল হিন্দু-মুসলিমসহ বিভিন্ন স্বাধীনতাকামি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নাগরিকদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে।
১৯৪৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত দীর্ঘ ৭৭ টি বছর কেটে গেলো। কিন্তু এ বঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা কখনোই শান্তিতে ছিলনা। নিরাপদে ছিলনা। এটি চরম ও নির্মম বাস্তবতা। আমার হিন্দু প্রতিবেশি, আমার কর্মক্ষেত্রের হিন্দু সহকর্মী, আমার বাল্যবন্ধু যে ধর্মে হিন্দু বা সনাতনী সে যদি নিরাপদে-শান্তিতে থাকতে না পারে, আমরা যদি তাদের আশ্বস্ত করতে না পারি, তার নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে কিসের স্বাধীনতা ? কিসের মানবাধিকার ? কিসের ভোটাধিকার ? কিসের গণতন্ত্র?
#নুরুল ইসলাম আনসারি। লেখক, গবেষক, ঢাকা, বাংলাদেশ।