বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা বিশেষ করে হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন নতুন কোন বিষয় নয়। তা সে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবিদার আওয়ামীলীগ সরকারের আমল হোক বা অন্য কোন সরকারের আমল হোক।
সেই ১৯৯২-১৯৯৩ সালে বিএনপি সরকারের আমলে তা আরো বেশি ছিল। এরপর ২০০১ সালে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট জেতার পর এই জোট সরকারের আমলে তা সারা দেশেই চরমভাবে ঘটেছে।
তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল এগুলো অতিরঞ্জিত। কিন্তু ২০২৪ সালে জুলাই-আগষ্ট মাসে ‘জঙ্গী ক্যু’ এর পর যেসব ঘটনা ঘটেছে তা অতীতের সবকিছুর রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
২০০১ এর অত্যাচার- নির্যাতন-ধর্ষণ-ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া-লুটপাট ইত্যাদিও বিষয়গুলো তখন অন্তত পত্রিকাতে লেখা যেতো, সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতো শত ভয় ভীতি থাকার পরও।
তখনো তৎকালীন সরকার, বিএনপি-জামাত গোষ্ঠী বেশ কয়েকজন মানবাধিকার সংগঠক ও সাংবাদিককে নানা মামলা, প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছে,হামলা করেছে। তারপরও তখন লেখা যেতো কিছুটা হলেও।
কিন্তু এই জঙ্গী- প্রতারক ইউনুস সরকারের আমলে তাও করা যাচ্ছেনা। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, কোন কিছু বললেই বা প্রতিবাদ করতে গেলেই তাদেরকে আওয়ামীলীগের দোসর বা ফ্যাসিবাদের ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে।
গত ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কি পরিমাণ হিন্দু নাগরিক দেশত্যাগ করে চলে গেছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই বা কেউই তা স্বীকার করতে রাজী নন সংগত কারনে। অসংখ্য মন্দির ভাঙ্গা হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
হিন্দুদের ঘরবাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লুট, ভাংচুর, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০০১ এ আমরা সিরাজগঞ্জের পূর্ণিমা রানী শীল এর করুন কাহিনীর কথা নিশ্চয় ভুলে যাইনি।
কিন্তু ২০২৪ এর আগষ্ট থেকে ২০২৫ এর জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশে এমন কত পূর্ণিমার কাহিনী লিখবো বা বলবো বলুন ? পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে- এসব বলা বা প্রতিবাদ করার মত কোন পরিস্থিতিও নেই।
তবে এরই মধ্যে এবছর অর্থাৎ ২০২৫ এর জুন ও জুলাই মাসে নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা, নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরে রাজধানী ঢাকায় সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের ১ নম্বর কক্ষে এক বিশেষ সেমিনার ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিস ( এইআরসিবিএম) নামে একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এর আয়োজন করেছিল। এই সংগঠনটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইবুন্যাল) -এর জন্য এনজিও জোটের সদস্য যা বাংলাদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছে। গত ১ জুলাই অনুষ্ঠিত এই সেমিনার ও আলোচনা সভায় বেশ কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
‘এইচআরসিবিএম’ বাংলাদেশ চ্যাপাটারের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট লাকী বাছার তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সেমিনারে কিছু তথ্য উপস্থাপনকালে বলেছেন- আমরা এখানে একটি ভয়াবহ ও করুণ বাস্তবতা তুলে ধরতে এসেছি- যেখানে নারী, শিশু, এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ প্রতিনিয়ত নিপীড়ন, নির্যাতন, এবং হত্যার শিকার হচ্ছেন; আর রাষ্ট্রীয় যন্ত্র প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে শুধু দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
* ২০২৫ সালের জুন ও জুলাই-সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের রক্তাক্ত দুই মাস
সেমিনারে তথ্য উপস্থাপনকালে বলা হয়- আমরা গভীর উদ্বেগ ও ব্যথার সঙ্গে জানাচ্ছি, ২০২৫ সালের জুন ও জুলাই মাসে নারী ও শিশুদের উপর যৌন সহিংসতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সন্ত্রাসী হামলা, ধর্মীয় নিপীড়ন, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ, মব হামলা, এবং নারী-শিশু হত্যার ঘটনা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
১. নারী ও শিশুর উপর যৌন সহিংসতা। জুন ১৪ – ৩০ জুন ২০২৫ (মাত্র ১৭ দিনে): ধর্ষণ: ৫৮ টি, ধর্ষণ চেষ্টা: ১১ টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ: ১৫ টি, ধর্ষণের পর হত্যা: ৬ টি, জুলাই ২০২৫ (পুরো মাসে): মোট যৌন সহিংসতার ঘটনা: ১৫৪ টি, ধর্ষণের চেষ্টা: ৩০ টি, ধর্ষণ: ৯৮ টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ: ১৯ টি, ধর্ষণের পর হত্যা: ৬ টি, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা: ১ জন
এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান আমাদের একটি নির্মম সত্যের মুখোমুখি করে-এই দেশে নারীর শরীর এখনো যুদ্ধক্ষেত্র, শিশুরা এখনো শিকার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা, এবং সামাজিক লজ্জার কারণে অনেক ঘটনা সামনে আসে না। আর যেগুলো সামনে আসে, সেগুলোর বিচারও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অদৃশ্য হয়ে যায়।
২. এবছর (২০২৫ সালে) জুন মাসে হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা ও ধর্মীয় নিপীড়ন-উপাসনালয়ে হামলা: ৬ টি, সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িঘরে হামলা: ৩ টি, সংখ্যালঘু হত্যা: ৮ জন, নিখোঁজ: ৮ জন, জোরপূর্বক ধর্মান্তর: ৬ জন, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ: ৮ জনের বিরুদ্ধে।
এ বছর (২০২৫ সার) জুলাই মাসে উপাসনালয়ে সহিংসতা, জমি দখল, প্রতিমা ভাঙচুর ইত্যাদি: ৯ টি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু ( হিন্দু) পরিবারের উপর সন্ত্রাসী হামলা, লুটপাট, জমি দখল, ডাকাতি: ৩৩ টি,সংখ্যালঘু নারী ও পুরুষ হত্যা: ৮ জন, জোরপূর্বক ধর্মান্তর : ৪ জন, ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ: ৪ জন, নিখোঁজ নারী ও শিশু: ২০ জন।
এই ঘটনাগুলো স্পষ্টভাবে দেখায় যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আজ অস্তিত্ব সংকটে। তারা নিরাপদে উপাসনালয়ে প্রার্থনা করতে পারছে না, ঘুমাতে পারছে না, এবং নিজ ধর্মে থাকতে পারছে না। ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং জমি দখলের মতো স্বার্থনির্ভর রাজনীতি তাদের লক্ষ্যে পরিণত করেছে।
৩. শুধুমাত্র জুলাই মাসে নারী ও শিশু হত্যা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৭৭ জন নারীকে খুন করা হয়েছে। ২৩ টি নিষ্পাপ শিশুকে মারা হয়েছে। এসব হত্যাকান্ডের পেছনে রয়েছে পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকের জন্য হত্যা, অজ্ঞাত কারণে হত্যা, এবং অপরাধ দমনে প্রশাসনের ব্যর্থতা। প্রতিটি ঘটনা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রতিবিম্ব।
৪. মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে গণপিটুনির অবস্থা মারাত্মকভাবে ভয়াবহ রুপ নিয়েছে।জুলাই মাসেই ৩৪ টি মব সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। মব সন্ত্রাস বা গণপিটুনি এখন যেন বিচার ব্যবস্থার বিকল্প হয়ে উঠেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, চুরির মিথ্যা অভিযোগ, কিংবা ধর্ম অবমাননার ভিত্তিহীন অভিযোগে একদল মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এই সংস্কৃতি আমাদের সভ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
* প্রশ্ন উঠছে-এই ভয়াবহতার পেছনে মূল কারণগুলো কী ?
এসবের উত্তর যদি খুঁজতে যাই আমরা দেখবো এই বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। এর পাশাপাশি রয়েছে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক প্রভাব, ইসলাম ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ ও মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে।
এসবের ফলে ভীতি ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে সংখ্যালঘুদের দমন করার চেষ্টাতো রয়েছেই। পাশাপাশি নারী ও শিশুদের সুরক্ষায় সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে প্রচন্ডভাবে।
হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফা বাংলাদেশ মাইনরিটিস (এইচআরসিবিএম) -এর কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে গত ১ আগষ্ট অনুষ্ঠিত সেমিনারে। এগুলো হলো-
১.সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতা, ধর্ষণ, এবং নারী হত্যার ঘটনায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে।
২. ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ রোধে আইন সংশোধন ও অপব্যবহার ঠেকাতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
৩. সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়, বাড়িঘর, এবং জমির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন ও ফোর্স চালু করতে হবে।
৪. জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও নিখোঁজ সংখ্যালঘুদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫. নারী ও শিশুদের জন্য জেলা ভিত্তিক সুরক্ষা সেল ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
৬. মব হামলা রোধে সামাজিক সচেতনতা, প্রযুক্তি-নির্ভর নজরদারি, এবং দ্রুত আইনগত পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
এইআরসিবিএম এটিকে নীরব গনহত্যা হিসেবে আখ্যা দিলেও আমি বলছি- সবকিছু মিলিয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে সরব ও নীরব গণহত্যা চলছে।
আজকের এই পরিসংখ্যান শুধুই সংখ্যা নয়-প্রতিটি ঘটনার পেছনে রয়েছে একেকটি ছিন্নভিন্ন পরিবার, একেকটি নষ্ট হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র যখন উন্নয়নের কথা বলে, তখন এক বিশাল জনগোষ্ঠী আতঙ্ক, নির্যাতন, এবং মৃত্যুর মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
মানবাধিকার এই সংগঠনটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান এই ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়গুরো তুলে ধরে বলা হয়েছে- আমরা মনে করি, এখনই সময় সত্য বলার।
রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয়, তবে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা সবাই মিলে আওয়াজ তুলতে পারি-যাতে কেউ আর জোর করে ধর্মান্তরিত না হয়, কেউ আর মিথ্যা অভিযোগে জেল না খাটে, কোনো নারী আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা না করে।
এইচআরসিবিএম এর মূল সংগঠক আমেরিকা প্রবাসী ধীমান দেব চৌধুরী জানিয়েছেন,তারা বিদেশে থাকলেও তাদের মন পড়ে রয়েছে এই বাংলাদেশে।
বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মীয় নাগরিকসহ সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার-গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তারা কাজ করে যাবেন।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত সেমিনার থেকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এইআরসিবিএম কিছু দাবি-আকুতি- স্লোগান তুলেছে।
তা হলো-
আমরা চাই না কোনো মা তাঁর ধর্ষিত মেয়ের মরদেহ কাঁধে তুলে কাঁদুক।
আমরা চাই না কোনো পূজারীর চোখের সামনে তাঁর মন্দির পুড়ে যাক।
আমরা চাই না কোনো শিশু নিখোঁজ হয়ে পরের দিন’ তার লাশ খুঁজে পাওয়া যাক।
আমরা চাই ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা, এবং মর্যাদা-সব নাগরিকের জন্য।
জয় হোক মানবতার, জয় হোক বাংলাদেশের সংবিধান ও মানবাধিকার চেতনার।
জাতির এই চরম ক্রান্তিলগ্নে যখন কেই কোন কথা বলতে পারছেনা এসব অত্যাচার নির্যাতন নিয়ে তখন ‘এইচ আর সি বি এম’ এর মতো একটি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান অন্তত কিছুটা হলেও সাহস করে এ কথাগুলো বলতে পেরেছে।
মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলো হয়তো এই সেমিনার কাভার করেনি বা করতে পারেনি বর্তমান জঙ্গী সরকারের রক্তচক্ষুর ভয়ে বা সেল্ফ সেন্সরশীপের কারণে।
কিন্তু এসব তথ্যতো আর এই ডিজিটাল সাইবার যুগে আটকে রাখার সুযোগ নেই। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে নিশ্চয় ছড়িয়ে গেছে। তারপরও যদি এই ইসলামী জঙ্গী ইউনুস সরকারের কোন লজ্জা হয়।
# ইশরাত জাহান, লেখিকা, প্রাবন্ধিক ও নারী অধিকার সংগঠক।