একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থানকারি অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী পরিবারকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়েছে। মানে তাদেরকে বাধ্য করা হয়েছিল। নাহলে তাদের জীবন বাঁচতোনা। কারা বাধ্য করেছিল ?
তারাই বাধ্য করেছিল যারা বাংলাদেশে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করেছিল তারা। তাহলে কারা কাজ করেছিল পাকিস্তানের পক্ষে তখন ? এর উত্তর হলো- জামায়াতে ইসলামী এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলো।
রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী ছিল জামায়াতের অধীনে। এদের অত্যাচারে তখন মানে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অনেক হিন্দু নাগরিক নিজেদের ধর্ম পরিচয় পাল্টে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু হিন্দুরা তখন বলতে বাধ্য হয়েছিল যে তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন।
একাত্তরের ডিসেম্বরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী শোচনীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনী তথা মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়েছিল। শুধু পাকবাহিনীই নয় তাদের যেসব সহযোগী বাহিনী ছিল অর্থাৎ জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রণাধীন রাজাকার- আলবদর- আলশামস বাহিনীও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে অমর দলিল রয়েছে তাতে স্পষ্ট করেই তা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু একাত্তরের সেই প্রতিশোধ আবার ২০২৪ ও ২০২৫ এ নিচ্ছে সেই নরঘাতকের দল জামায়াতে ইসলামী।
একাত্তর সালে তারা এই মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্রে ইসলামের ওপর হিন্দুদের আক্রমণ হিসেবে অপপ্রচার করেছিল। আর সেজন্য কিন্তু বেছে বেছে হিন্দুদেরকেই বেশি মেরেছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও জামায়াতের ক্যাডাররা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর বিভিন্ন সময়ে নানা ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হয়েছে। কিন্তু শহীদদের তেমন কোন তালিকা হয়নি।
সেই তালিকাটি যদি হতো ঠিকভাবে তাহলে দেখা যেতো শহীদদের তালিকায় হিন্দুদের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও চরম বাস্তবতা হলো- সে তালিকায় হিন্দুদের তেমন স্থান হয়নি। আর তখন পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে যে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছিল তার মধ্যে অন্ততপক্ষে ৯৫ ভাগ শরণার্থী ছিল হিন্দু। মুসলিমদের সংখ্যা ছিল অনেক কম।
কারণ পাকবাহিনী ও তাদের পূর্ব পাকিস্তানের দোসর জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য মুসলিম রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিমদেরকে রক্ষা করেছিল। কারণ পশ্চিম পাকিস্তান এই মুক্তিযুদ্ধটিকে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যেকার বিরোধ ও ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ এবং যুদ্ধ হিসেবে প্রচার করেছিল।
২০২৪ সালে জুলাই-আগষ্ট মাসে ইসলামী জঙ্গী সন্ত্রাসের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর আবার সেই একাত্তরের পরিস্থিতি ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। তবে সেই পরিস্থিতি একাত্তরের চেয়ে ভয়াবহ।
একাত্তর সালে তবু মুক্তিযোদ্ধারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াত নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তির বিরুদ্ধে।
কিন্তু এবার সেটি একেবারেই অনুপস্থিত। বরং উল্টো যে দলটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল সে দলটির অনেক নেতাকর্মীই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে।
অবশ্য আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোকে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামী ও অন্য চরমপন্থী ইসলামী দলগুলো অত্যন্ত সফলতার সাথে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছে।
সেই একাত্তর সালের মতোই ২০২৪ সালেও হিন্দুদের ওপর চরম আক্রমণ নেমে আসে। যদিও জঙ্গী ইউনুস সরকার কোনভাবেই এটিকে হিন্দুদের ওপর হামলা বলতে রাজী নয়।
কিন্তু সারাবিশ্ব জানে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর কি বিভৎসতা চলেছে ও চলছে। গত ২০২৪ সালের আগষ্ট থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে হিন্দুদের কেউ কেউ জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিচ্ছেন।
বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে সব খবর আমরা দেখেছি। ঠিকই বুঝতে পারি- প্রাণ বাঁচানো , মান সম্মান, নারীদের সম্মান রক্ষা যে বড় দায় হিন্দুদের।
আমার বেশ কিছু হিন্দু বন্ধু-বান্ধব-সহকর্মীদের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে যেসব খবর পাই তা আরো ভয়াবহ। যেসব খবর সাধারণত সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশ পায়না।
কারণ সংবাদ মাধ্যমও ‘মব সন্ত্রাস’ এর ভয়ে অস্থির। আর এরই মধ্যে অধিকাংশ মিডিয়া বিএনপি- জামায়াতের নেতাকর্মীরা দখল করে নিয়েছে।
এরই মধ্যে একটি সংবাদ চোখে পড়লো। বাংলাদেশের অন্যতম অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে প্রচারিত একটি নিউজ। সে নিউজটি পড়ে বুঝে নিতে হবে সত্যিকার অর্থে কেমন বিভীষিকার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে বাংলাদেশের হিন্দুরা।
নিউজটি ছিল এমন- “ জামায়াতে যোগ দিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২৫ ‘সনাতন’ ধর্মালম্বী। আমরা আমাদের ধর্ম পালন করব; তারা তাদের ধর্ম পালন করবে। এতে কারও কোনো সমস্যা হবে না- বলেন সুমন কুমার সাহা।”
তাদের চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধির বরাত দিয়ে প্রচারিত এই সংবাদটিতে জানানো হয়েছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার ২৫ জন ‘সনাতন’ ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছেন।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর রোববার বিকেলে দলের জেলা কার্যালয়ে প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণ করেন।
জামায়াতে নাম লেখানো সুমন কুমার সাহা বলেন, “আমরা জামায়াতে ইসলামীতে যোগদান করেছি, কারণ এ দলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা আমাদের ভালো লাগে।
“আমরা আমাদের ধর্ম পালন করব; তারা তাদের ধর্ম পালন করবে। এতে কারও কোনো সমস্যা হবে না।”
জামায়াতে যোগদানকারীদের মধ্যে রয়েছেন- পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সুকুমার পরামানিক, চন্দন দাস, সুদর্শন মন্ডল, বক্ষনাথ ঠাকুর, কানাই চৌধুরী, ভরত চৌধুরী, সতীশ মন্ডল, বাবলু মন্ডল, সিতু মন্ডল, সুমল মন্ডল, দলন মন্ডল, মন্টু লাল চৌধুরী।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংসদ লতিফুর রহমান বলেন, ‘সনাতন’ ধর্মাবলম্বীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতিতে যোগদান করেছেন।
“আমাদের রাজনীতি নীতি, আদর্শ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। তাদের এ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে মানুষ আদর্শভিত্তিক রাজনীতির প্রতিই আস্থা রাখে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ২৫ জন জামায়াত ইসলামীতে যোগদান করেছেন । আগামীতে আরো অনেকেই যোগ দেবেন।”
তিনি বলেন, “আমাদের গঠনতন্ত্রে আছে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি এবং অর্থনীতি ব্যবস্থার সাথে ঐক্যমত পোষণ করে যেকোনো ধর্মের মানুষ যুক্ত হতে পারবেন। তারা তাদের ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবেন।”
এই যে পরিস্থিতি তা যে কোনভাবেই স্বাভাবিক ও স্বেচ্ছায় নয় তা আর নতুন করে বলে দেয়ার কোন দরকার আছে বলে মনে করিনা। এই যে জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়া হিন্দু মানুষগুলো যেসব কথা বলেছেন তা তারা কেন বলেছেন সেটি বেশ বোধগম্য।
বাংলাদেশের নাগরিকদের যে কোন রাজনৈতিক দল করার অধিকার আছে ( শুধুমাত্র আওয়ামীলীগ ছাড়া, কারণ এটি নিষিদ্ধ দল এখনকার জঙ্গী ইউনুস-জামাতীয় জমানায়।
প্রশ্ন অন্য জায়গায়। জামায়াত তো বাংলাদেশের সংবিধানকে অস্বীকার করে। তারা বলে যে, আল্লাহর নামে কোরআনের আইন ও শাসন কায়েম করবে তারা।
এই যে হিন্দু নাগরিকরা জামায়াতে ইসলামে যোগ দিলেন তাদেরকেও নিশ্চয় ‘ কোরআনের আইন ও শাসন ‘ মানতে হবে। তা যদি তারা মানতে যান তাহলে তারা কি আর হিন্দু থাকবেন ?
২০২৪ সালের ১৯ আগষ্ট জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান রাজধানীর কাফরুলে কেন্দ্রীয় মন্দির পরিদর্শনকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের পুরোহিত ও নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভায় বলছিলেন-
“আমাদের প্রথম পরিচয় আমরা মানুষ। আমাদের দ্বিতীয় পরিচয়, এদেশে আমাদের যাদের জন্ম হয়েছে আমরা সবাই বাংলাদেশী। একজন বাংলাদেশী নাগরিককে আমার দেশের সংবিধান যে অধিকার দিয়েছে সকল ধর্মের নাগরিক সমানভাবে তা ভোগ করবে। আমরা তার কমবেশি দেখতে চাই না।”
কিন্তু যেখানে জামায়াতে ইসলামী মানব রচিত কোন আইনে বিশ্বাসী নয় সেখানে বাংলাদেশের সংবিধান মানবেন কি করে?
কিন্তু বাস্তবতা হলো- জামায়াত মুখে যা বলে অন্তরে তা বিশ্বাস করেনা, যা বিশ্বাস করে তা মুখে বলেনা। একাত্তর সালে এই মাটি-মানুষের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী যে চরম বেইমানী করেছে। তারপরও গত ৫৪ বছর ধরে করেছে। ভবিষ্যতেও যে করবে এ বিষয়টি অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায়।
জামায়াত মুখে এক কথা বলে, কাজে করে তার পুরো উল্টোটা। একাত্তর থেকে এ অবধি তাদের যেসব অপকর্ম দেখেছি আমরা তাতেই বোঝা যায়।
২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল একাত্তরের ঘাতক চরম মিথ্যেবাদী দেলোয়ার হোসেন সাঈদী’র মৃত্যুদন্ড ঘোষণার পর সারাদেশে জ্বালাও পোড়াও ও তান্ডব চালিয়েছিল। তা নিশ্চয়ই এ দেশের জনগন ভুলে যায়নি।
তখন চট্টগ্রাম , রংপুর , সিলেট , চাঁপাইনবাবগঞ্জ , বগুড়া এবং দেশের অন্যান্য অনেক জেলায় ৫০ টিরও বেশি মন্দিরে হামলা-ভাংচুর-আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল জামায়াত-শিবিরের ক্যাডারা।
অন্ততপক্ষে ২০০০ ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট করেছে তারা। সুতরাং সেই উগ্র চরম সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল ও এই দলের নেতাকর্মীরা যে চরম ধোঁকাবাজ ও দেশদ্রোহী তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।
#নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, প্রাবন্ধিক।