লেখার শিরোনাম দেখে চমকে উঠলেনতো ! হয়তো ভাবছেন এ আবার কেন কথা – একাত্তর ভার্সেস একাত্তর? এর মানে আপনারাও সবাই জানেন। তা হলো- ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যেমন নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙ্গালীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্বিচারে মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছিল ঠিক তেমনটিই চলছে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে।
তখন বাধ্য হয়ে পাকি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর- রাজাকার-আলবদর-আলশামস অর্থাৎ পাক হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগীদের বিরুদ্ধে বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরে মরণপণ লড়াই করেছিল।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস সেই পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় নরপিশাচদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল। বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে স্থাপন করেছিল একটি স্বাধীন বাংলাদেশের। সবুজ জমিনে একটি রক্তলাল পতাকা উড়িয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।
অবনতমস্তকে একাত্তরের পরাজিত শক্তি পরাজয় মানতে বাধ্য হয়েছিল।
কিন্তু গত ২০২৪ এর জুলাই-আগষ্টে এক ইসলামী জঙ্গী সামরিক ক্যু এর ফলে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে একাত্তরে অর্জিত বাংলাদেশটি আবারো সেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির কাছেই চলে গেলো।
পাক-মার্কিন ও ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের কাছে বাংলাদেশ বার বার মার খাচ্ছে। তারমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে পরাজিত শক্তি রয়ে গেছে তাদের ষড়যন্ত্র এমন পাকাপোক্তেভাবে গেড়ে বসেছে যে, বার বারই একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত মুক্তিকামী বাঙ্গালী হোঁচট খাচ্ছে।
সেই ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ( দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশে না থাকায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান) হত্যার মধ্য দিয়ে একাত্তরের পরাজিত পাক-মার্কিন চক্র প্রথম প্রতিশোধ নিতে শুরু করে।
যে দলটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই আওয়ামীরীগ যাতে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে তারই নীলনকশা হিসেবে একই বছর ৩ নভেম্বর কারাগারে নিষ্ঠুর-অমানবিকভাবে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা জাতীয় চার নেতাকে ।
ষড়যন্ত্রকারিরা ভেবেছিল বাঙ্গালী আর কখনো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাহাত্তরের মহান সংবিধানকে সামনে রেখে এগুতে পারবেনা। কিন্তু শত-সহস্র খুন-অত্যাচার-নির্যাতন-মামলা-হামলা ও নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েও সেই একাত্তরের চেতনাকে বুকে ধারণ করে বাঙ্গালী বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু সেই দেশি-বিদেশী চক্রান্ত কিন্তু থেমে নেই। তারা নানাভাবেই চেয়েছে বাঙ্গালীর কাছ থেকে “ একাত্তর” কে কেড়ে নিতে। কিন্তু যে বাঙ্গালীর জন্মপরিচয় “ বায়ান্ন ও একাত্তর” মধ্য দিয়ে তার কাছ থেকে এই গর্বের ধন “বায়ান্ন” আর অহংকারের ধন “ একাত্তর” কেড়ে নেয়া এত সহজ নয়।
গত চব্বিশের ৫ আগষ্ট মার্কিন “ডিপষ্টেট’ “ , সেই নীলনকশা অনুযায়ী নোবেল লরিয়েট ড. মুহম্মদ ইউনুসের “ মেটিকুলাস ডিজাইন “ এর গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে দিয়ে একাত্তরের বাংলাদেশকে আবারো হিংস্র হায়েনারা দখল করেছে।
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু যদিও তখন চরম বিশ্বাসঘাতক সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। কিন্ত অদ্যাবধি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ এর কোন প্রমাণ তারা কোথাও দেখাতে পারেনি। ফলে এ নিয়েও এক ধরনের সমস্যায় রয়েছে ক্ষমতার অবৈধ দখলদার-অসাংবিধানিক ইউনুস সরকার ও তার অধীনস্থ সরকার।
বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানে অধীনে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ নিয়ে অবৈধ-অগণতান্ত্রিকভাবে সরকারী প্রশাসনযন্ত্র দখল করলেও এই সরকার সংবিধানের কোন কিছুই মানছেনা।
সেনাবাহিনী তথা সশস্ত্র বাহিনী কিন্তু এই সংবিধান রক্ষা ও দেশরক্ষার শপথ নেয় যখন তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। সেই সশস্র বাহিনীও কিন্তু সংবিধানকে অবজ্ঞা করছে নানাভাবে। কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না। জঙ্গী ড.ইউনুস সরকার ( যারা মূলত পাক-মার্কিন-তুরষ্কের এরদোগান নিয়ন্ত্রিত সরকার) ও সংবিধানকে থোড়াই কেয়ার করে।
আর ইউনুসের নিয়োগকর্তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভিনেতারা যারা এখন জঙ্গী টোকাইদের দল এনসিপি নামে পরিচিত তারাতো কথায় কথায় সংবিধানকে পদদলিত করছে। অপরদিকে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর দল-নরঘাতকের দল জামায়াতে ইসলামীতো ‘ কোরআন’ কেই সংবিধান মানে।
কিন্তু এই সংবিধানের অধীনে তারা এই দেশে রাজনীতি করছে, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীও হয়েছে। তারমানে এই যাদের নিয়ে আলোচনা করলাম এরা সবাই চরম হিপোক্রেট। শুধু তাই নয় চরমভাবে দেশদ্রোহী ।
যা নিয়ে শুরু করেছিলাম লেখাটি, একাত্তর ভার্সেস একাত্তর বা একাত্তর বনাম একাত্তর। কেন বলেছি ? একাত্তরে স্বাধীনতাকামি বাঙ্গালী যুদ্ধ করেছিল পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে। আর পাক হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসররা যুদ্ধ করেছিল মুক্তিকামী বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে। তারমানে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাও যেমন ছিল তেমনি পাক-রাজাকার বাহিনীও ছিল।
সেই একাত্তর থেকে ২০২৪ বা ২০২৫ অবধি অনেক লম্বা সময়। প্রায় ৫৩/৫৪ বছর । এই ২৪/২৫ এ এসেও বাঙ্গালী তার আত্মপরিচয়ে ভোগে ! বাঙ্গালিকে তার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯ এর গনঅভ্যুত্থান সব ভুলিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা হচ্ছে।
সবচেয়ে ন্যক্কারজনক বিষয় হলো বাঙ্গালীর মূল যে পরিচয় একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই একাত্তরকে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে ওইসব টোকাই জঙ্গী এনসিপিসহ সহ তাদের দোসররা। আর জামায়াতে ইসলামী পেছনে থেকে, এখন অবশ্য একেবারে সামনে এসেই কলকাঠি নাড়ছে। নেতৃত্বই দিচ্ছে এসব অপকর্মের।
এরমধ্যে সারাদেশেই মুক্তিযুদ্ধের সব চিহ্ন ধ্বংস করেছে । স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযোদ্ধা, বাঙ্গালি সংস্কৃতি, লালন-বাউল-রবিঠাকুরসহ সব কিছুর ওপরে হামলা করেছে, ধ্বংস করেছে। এমনকি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পীর-আউলিয়াদের মাজারও ভাংচুর ও হামলা থেকে রেহাই পায়নি এই ইসলামী জঙ্গীদের হাত থেকে।
এরা আইন মানেনা। আদব-কায়দা মানেনা। মুরুব্বি মানেনা। মা-বোনদের মানেনা। শিক্ষকতো মানেইনা। বরং শিক্ষককে এরা চরমভাবে অপমানিত করেছে, করে যাচ্ছে। আবার শোনা যাচ্ছে কোন কোন উপদেষ্ট বা এনসিপি’ অভিনেতার পিতা নাকি শিক্ষক ছিলেন। যিনি আবার ঠিকাদারি ব্যবসা করার জন্য লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়ে ধরাও খেয়েছেন।
** তবে হ্যাঁ এদের কাছে আইন হলো- ‘ মব সন্ত্রাস’।
যতদূর জানি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি হলো সব মতাদর্শের সাংবাদিকদের একটি মিলনক্ষেত্র। সেখানে বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময়েও যেমন চরম আওয়ামীবিরোধীরা গিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পেরেছেন। তেমনি তার পরবর্তী সময়েও এখনকার ইউনুস সরকারের নানা অসঙ্গতি- অনিয়ম-দুর্নীতি-দুঃশাসন ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকবে এমনটাই প্রত্যাশা ছিল ডিআরইউ নেতৃবৃন্দের। কিন্তু সেটি ভুল প্রমাণিত করে দিলো জামায়াত-শিবির চক্র।
প্রসঙ্গত: ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে ‘মঞ্চ ৭১’ এর উদ্যোগে “মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সংবিধান” শীর্ষক আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু সভা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই গত ২৮ আগষ্ট ‘ মঞ্চ ৭১” এর অনুষ্ঠানে বর্ষিয়ান মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক, প্রতিবাদী-সত্যকথা বলা সাংবাদিকসহ মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নাগরিকরা চরমভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। বর্ষিয়ান বীর মুক্তিযোদ্ধার কন্ঠনালী চিপে ধরে মেরে ফেলার হিংস্রতা দেখেছি।
আরেকজন প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধাকে মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছে। সবই করা হয়েছে জুলাই যোদ্ধাদের নামে। যেই জুলাই যোদ্ধারা হচ্ছে জঙ্গী সন্ত্রাসী ও এদেশটিকে পাকিস্তানের অংশ বানানোর ফ্রন্টলাইনের কারিগর।
বৃহস্পতিবার মাত্র জনা ত্রিশেক জঙ্গী সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক, সাংবাদিক, সাবেক সচিবসহ একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী সম্মানিত নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে ও অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
একদল মব সন্ত্রাসী জঙ্গী হামলা করলো “ মঞ্চ ৭১” এর আয়োজক ও উপস্থিত অতিথিদের ওপর, তাদেরকে গ্রেপ্তার না করে উল্টো বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন এবং সাংবাদিক মঞ্জরুল আলম পান্নাসহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। এটাই হচ্ছে আজকের বাংলাদেশ। থুড়ি পাকিস্তান অথবা বাংলাস্তান। আর কিছু কি বাকী আছে এই বাংলাদেশের?
** ডিআরইউ’র প্রতিবাদ।
বৃহস্পতিবার রাতে ওই আলোচনা সভা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদলিপি দিয়েছে ঢাকার প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিআরইউ।
এতে বলা হয়েছে, “ডিআরইউ’র একটি গোলটেবিল বৈঠকে বৃহস্পতিবার কতিপয় বহিরাগতদের হামলাকে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদল ব্যক্তি নিজেদের ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন), সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানসহ কয়েকজনকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
”এসময় তাদেরকে নিবৃত্ত করতে গেলে ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মান্নান মারুফ, সদস্য আসিফ শওকত কল্লোল, সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদসহ কয়েকজনকে নাজেহাল করা হয়।”
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংগঠনের সভাপতি আবু সালেহ আকন ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল ঘটনার বলেন, “ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সবারই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
এই অনুষ্ঠান ঘিরে কতিপয় লোক গতকালই (বুধবার) ফেইসবুকে হুমকি দিয়ে প্রচারণা চালায়। এর প্রেক্ষিতে শাহবাগ থানাকে অবহিত করার পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ডিআরইউ প্রাঙ্গণে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে।
”অনুষ্ঠানটি উন্মুক্ত হওয়ায় হঠাৎ করেই একদল লোক অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করে মব সৃষ্টির চেষ্টা করে। ডিআরইউ নেতারা এবং সদস্যদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর পুলিশকে অবহিত করার পর তারা এসে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীসহ কয়েকজনকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়।”
ডিআরইউ নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবের সময়েও ডিআরইউতে সবার কথা বলার সুযোগ ছিল।
“গণ অভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন সরকারের বাধার মুখেও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ, সারজিস ও হাসনাতরা এখানে কথা বলেছেন।
”আগামী দিনে কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে ডিআরইউ তা প্রতিহত করবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
** কাকে চপেটাঘাত করলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী !
শুক্রবার ২৯ আগষ্ট ঢাকার একটি আদালতে মঞ্চ ৭১ এর অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া অতিথিদের মধ্য থেকে যে ১৬ জনকে আদালতে হাজির করার পর লতিফ সিদ্দিকী ছাড়া সবাই জামিনের জন্য আবেদন করেছেন নিয়ম মেনে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফ সিদ্দিকী।
শুক্রবার আইনজীবী সাইফুল ইসলাম সাইফ বলেন, “লতিফ সিদ্দিকীর জামিনের প্রার্থনা করতে যখন তাঁর কাছে ওকালতনামায় স্বাক্ষর করতে যাই আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে, তখন তিনি বলেন, “ যে আদালতের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তার কাছে কেন জামিন চাইব? আমি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করব না, জামিন চাইব না “।
তাঁর কাছে বেশ কয়েকবারই জামিনামায় স্বাক্ষরের জন্য যাওয়া হয়েছে, কিন্তু ৮৮ বছর বয়সী এই প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা কোনভাবেই জামিন আবেদন করেননি।
তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন—“ যে আদালতের জামিন দেওয়ার ক্ষমতা নেই, তার কাছে কেন জামিন চাইব? আমি ওকালতনামায় স্বাক্ষর করব না, জামিন চাইব না “। — এটি কার প্রতি চপেটাঘাত ?
আদালত-প্রশাসন-সরকার নাকি এখনকার সমাজব্যবস্থার প্রতি ? সত্যি আদালতে এই বয়সেও তিনি হাসতে হাসতে কাঠগড়ায় গেছেন, কারাগারে গেছেন।
লতিফ সিদ্দিকী ও কার্জন ছাড়া বাকি ১৪ জন হলেন- মঞ্জরুল আলম পান্না (৪৯), কাজী এ টি এম আনিসুর রহমান বুলবুল (৭২), গোলাম মোস্তফা (৮১), মো. মহিউল ইসলাম ওরফে বাবু (৬৪), মো. জাকির হোসেন (৭৪), মো. তৌছিফুল বারী খান (৭২), মো. আমির হোসেন সুমন (৩৭), মো. আল আমিন (৪০), মো. নাজমুল আহসান (৩৫), সৈয়দ শাহেদ হাসান (৩৬), মো. শফিকুল ইসলাম দেলোয়ার (৬৪), দেওয়ান মোহম্মদ আলী (৫০), মো. আব্দুল্লাহীল কাইয়ুম (৬১)।
** বীরত্বের সাথে কথা বলেছেন অধ্যাপক কার্জন ও সাংবাদিক পান্না।
আদালতে শুনানি শেষে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার সময় অধ্যাপক কার্জন বলেন, “আমি তো মারা যাব। আমাদের মেরে ফেলবে। আমরা সন্ত্রাসের শিকার, আমাদের জেলে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ, আদালত আমাদের কোনো বিচায় দেয়নি। আমরা ন্যায়বিচার পাইনি। দেশ এখন পাকিস্তানপন্থিদের হাতে। এটা চলবে না। ইনশাআল্লাহ এ দেশটাকে আমরা অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে পরিণত করব।”
আদালত চত্বরে সংবিধান উঁচু করে সাংবাদিকদের দেখিয়ে তিনি বলেন, “এটা মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান। আমরা রক্ষা করব। মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে, ৫ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ সংবিধান। এই সংবিধান, দেশ আমরা রক্ষা করব।”
ওই সময়ে সাংবাদিক মঞ্জুর আলম পান্না বলেন, “যারা সন্ত্রাস করল, তাদের ধরল না। আর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেই, লিখলেই সন্ত্রাসী হয়ে যায় ? তিনি আদালতে ঢোকার সময় হাতের হাতকড়া উঁচিয়ে বলেন, সত্যকথা বলার জন্য হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে কথা বললেই সন্ত্রাসী হয়ে যেতে হবে ? সংবিধান নিয়ে কথা বললেই সন্ত্রাসী ? আর যারা হামলা করলো তাদের কিছু হলো না ! “
** মঞ্চ ৭১ এর দাবি।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি রোধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান রক্ষার দাবি তুলে ‘মঞ্চ ৭১’ নামে মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন প্ল্যাটফর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। মুক্তিযোদ্ধা, নতুন প্রজন্ম ও ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত এ প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করছেন গণফোরামের নেতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (বীর প্রতীক) ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
“মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। লাখো শহীদের রক্ত, মা-বোনদের সম্ভ্রম আর কোটি কোটি মানুষের মহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, একটি পতাকা নয়, একটি জাতীয় সংগীত নয়, বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন, চেতনা, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
“কিন্তু আমরা নিদারুণ বেদনা, ক্ষোভ আর হতাশার সঙ্গে লক্ষ করছি, আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। অগাস্ট অভ্যুত্থানের পর কথিত নানা ঘোষণাপত্র এবং বয়ানের মধ্যে জাতির সামনে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, আদর্শ অর্জনকে হেয় করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। ইতিহাস বিকৃতির মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যাখ্যানের চেষ্টায় বীর মুক্তিযোদ্ধারা গভীরভাবে মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ।”
“এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধা, নতুন প্রজন্ম এবং ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিরা সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বন্ধের লক্ষ্যে ‘মঞ্চ ৭১’ এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।”
মঞ্চ ৭১ এর পক্ষ থেকে পাঁচটি দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হল-
১) জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বক্তব্য ও ব্যাখ্যা থাকবে না, তা নিশ্চিত করতে হবে। জুলাই ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিপক্ষে অসম্মানজনক কিছু থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করা হবে।
২) মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলে তথাকথিত নতুন সংবিধান প্রণয়ন করার অপপ্রয়াস বাঙালি জাতি কোনো দিন মেনে নেবে না।
৩) কোনো রাজনৈতিক দলের অপরাধ ও ব্যর্থতার দায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা যাবে না।
৪) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা, ইতিহাস মুছে ফেলা, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার সঙ্গে সংযুক্ত সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবিলম্বে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার এবং বিচার করতে হবে।
৫) অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। তাদের বলতে হবে, তারা কী মনে করে, কী করবে আর কী করবে না।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, “ইদানিং আমরা দেখতে পাচ্ছি কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকে ২০২৪ সালের আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করার চেষ্টা করে। কোথায় মুক্তিযুদ্ধ আর কোথায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান?
কোন আন্দোলন করতে গিয়ে পেয়ে গেছেন রাষ্ট্র ক্ষমতা। এখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাংলাদেশ সৃষ্টির, আর কোথায় ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান…। “বলতে গেলে বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ বেহাত হয়ে যাচ্ছে, আমরা মুক্তিযুদ্ধারা বেঁচে থাকতে এটা হতে দিতে পারি না। আমরা কোনো দলের পারপাস সার্ভ করার জন্য প্লাটফর্মটি করি না, মুক্তিযুদ্ধ অতুলনীয়, সেটা নিয়ে কাজ করব।”
** সাংবাদিক আঙ্গুর নাহার মন্টি লিখেছেন, চব্বিশের ৫ আগস্টের পর মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা হেয় করার এক ভয়ংকর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর এটা করা হচ্ছে মব সন্ত্রাসের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে এমন রাজনৈতিক দলগুলোও কখনও নিরব থেকে এই হেয় করায় সায় দিচ্ছে।
আবার মবের মোড়কে চিহ্নিত রাজনৈতিক কর্মী ও গোষ্ঠীর চাপে মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছে। আসলে আওয়ামী লীগ বিরোধিতার মোড়কে খুব কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর উপর আঘাত করা হচ্ছে। এ যেন একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও তাদের দোসরদের ৫৪ বছর পর পাওয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার। মনে রাখবেন, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের যতো হেয় করা হবে ততোই ফুঁসে উঠবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ !
এ ব্যাপারে এদেশের মানুষ কখনোই ছাড় দেবে না। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলোকেও ওই সময়ের অবস্থানের জন্য ক্ষমা চেয়েই সামনে এগোতে হবে।
ওই যে শুরুতে বলছিলাম ‘ একাত্তর ভার্সেস একাত্তর”। বাংলাদেশে আবারো সেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শক্তি ও একাত্তরের পরাজিত অপশক্তি’ মধ্যে তীব্র বিরোধের নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সুতরাং আবারো সেই হারানো বাংলাকে ফিরিয়ে আনতে প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা যারা এখনো বেঁচে আছেন তাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্ধকার শেষে আলো আসবেই।
# নুরুল ইসলাম আনসারি: লেখক, প্রাবন্ধিক