গোপালগঞ্জের সাম্প্রতিক ঘটনা গত ১৬ জুলাই থেকে শুরু। সাদাচোখে দেখলে তাই মনে হবে। কিন্তু ঘটনার সূত্রপাত অনেক আগে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়ি বুলডোজারে গুড়িয়ে দেয়া হলো। তার আগে আগুন লাগানো হলো।

পুড়িয়েও যখন সেটি পুরো শেষ করা যায়নি তখন বুলডোজার এনে সে কাজটি করা হলো। তখনও কিন্তু সেখানে ‘ দেশপ্রেমিক’ সেনাবাহিনী গিয়েছিল। তবে মব সন্ত্রাস করে একাত্তরের পরাজিত শক্তির এ প্রজন্মের দোসরদের ইতিহাস ধ্বংসের কাজে বাধা দিতে নয়।

বরং একটু সুপারভাইস করতে নিশ্চয়। তা নাহলে সেখানে কোনভাবেই মব সন্ত্রাস করতে পারতো না এ প্রজন্মের রাজাকাররা। যেহেতু বঙ্গবন্ধু দেশটিকে স্বাধীন করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর তাঁর বাড়ি সেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়।

সুতরাং সেটি ধ্বংস না করলে এ দেশের বাঙ্গালীদের মনে আবেগ থেকে যাবে। সেই আবেগের বশবর্তী হয়ে, চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে কিছু করে বসতে পারে সারা দেশেই।

বিক্ষুব্ধ বঙ্গবন্ধু প্রেমীরা যদি আবার পাকিস্তানের জারজ সন্তান তথা জামাত- এনসিপি- হিযবুত জঙ্গীদের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসে তাহলে বিপদ ভয়াবহ — এটি নিশ্চিত।

গোপালগঞ্জে এখন যে ধরপাকড় নির্যাতন চলছে তাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হিন্দুরা। কারণ গোপালগঞ্জ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। তাই মানবাধিকার সংগঠন গুলোর সোচ্চার হওয়া জরুরী।

একাত্তরে পাক- মার্কিন ষড়যন্ত্রের পরাজয়ের ‘মধুর’ প্রতিশোধ নিয়েছে তারা প্রথম ধাপে। সেটি ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট রাতের আঁধারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম খুনের মধ্য দিয়ে।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিবকে সেখানে মারতে সাহস করেনি। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে ঠিকই গভীর ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে তাঁকে খুন করানো হলো।

আর যেসব সেনা সদস্য এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তারা পাকিস্তানী নয় খোদ এই বাংলাদেশের সন্তান! একটিবার ভাবুনতো কি মধুর (!) প্রতিশোধ। কেউ যাতে বলতে না পারে পাকিস্তান বা আমেরিকা মেরেছে।

এই যে নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ হলো তখনও কিন্তু পাকবাহিনী ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটিকে ধ্বংস করেনি। বরং তার পরিবারের সদস্যরা যাতে কোথাও যেতে না পারে সেজন্য কড়া পাহারা দিয়েছে পাকসেনারা।

কিন্তু বাড়ির কিছুই করেনি। জিয়াউর রহমান বন্দুকের নলের মুখে ক্ষমতায় এসেও কিন্তু এই ৩২ নম্বরের বাড়িটি ধ্বংস করেনি। বরং শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরার পর এই বাড়িটি উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল।

যদিও বঙ্গবন্ধু মুজিবের হত্যার সঙ্গে জিয়ার ঘনিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে বলেই নানা তথ্য প্রমান বিদ্যমান।

জিয়া-এরশাদ- খালেদা এরা সবাই বঙ্গবন্ধু বিরোধী ছিলেন। তবে এদের কেউই কিন্তু টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থলের ওপর শ্যেণ দৃষ্টি দেননি। যদিও এ তিনজন সরকার প্রধানই পাকিপন্থী ছিলেন।

 

কিন্তু ১৯৭৫ থেকে ২০২৫। অর্ধশত বছর হলো বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের। এই পঁচিশে দেশ পরিচালনা করছে পাকিজঙ্গী সমর্থিত- মার্কিন মদদপুষ্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনুস। তবে তার সাথে রয়েছে ঘোষিত স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী, হিযবুত তাহরির ও জঙ্গি টোকাই দল এনসিপি।

মূলত একটি মেটিকুলাস ডিজাইনের মধ্য দিয়েই গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপি’র ” লংমার্চ টু গোপালগঞ্জ” কর্মসূচি ছিল। সারাদেশে এনসিপি করেছে পদযাত্রা ( যা বাস্তবে অসংখ্য গাড়ির বহর) করলেও গোপালগঞ্জে ছিল ভিন্ন কর্মসূচী।

এটি মূলত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় যে বীরপুরুষ শুয়ে আছেন সাড়ে তিন হাত মাটির কবরে সেটিকে অপমান করা? সেটিকে ঘিরে যে স্থাপনা রয়েছে সেগুলোকে বুলডোজারে গুড়িয়ে দেয়া?

তবে গোপালগঞ্জ বাসীর উদ্দেশ্যে আগে থেকেই উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে টোকাই জঙ্গী পার্টি এনসিপির টোকাই নেতারা। তারউপর ১৬ জুলাই প্রায় পাঁচ হাজার পুলিশ, এলিট ফোর্স Rab, বিজিবি ও সেনাসদস্য দিয়ে বলতে গেলে একধরনের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরী করে তারপর সেখানে গাড়ির বহর নিয়ে গিয়েছিল নাহিদ, সারজিস, হাসনাতসহ টোকাই জঙ্গী দলটির নেতাকর্মী ও ক্যাডাররা।

তাদের এই বহরে সশস্র রোহিঙ্গা ক্যাডারদের একটু গ্রুপও ছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু সেখানে সভাস্থলে জনগণ বিহীন সমাবেশে গিয়ে এনসিপি নেতারা ” মুজিববাদ মুর্দাবাদ” শ্লোগানসহ আপত্তিকর বক্তব্য দেয়ায় তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধু সমর্থক ও সাধারন গোপালগঞ্জবাসীর মধ্যে।

তারপরই সেখানে এনসিপি নেতাদেরকে ধাওয়া দেয়।শেষ পর্যন্ত তাদের প্রাণ বাঁচাতে সেনাবাহিনীর সুরক্ষিত এসিপি’ তে করে খুলনা নিয়ে যাওয়া হয়।এই কাজটি করেছিল ” দেশপ্রেমিক” সেনাবাহিনী।

আর এনসিপি’র জঙ্গী নেতাদের বক্তব্যের প্রতিবাদে নিরস্ত্র সাধারন জনগনের ওপর মুহূর্মুহু সয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে এই ” দেশপ্রেমিক” বাহিনীকে। পুলিশও ছিল মারাত্বক মারমুখী।

পুলিশসহ সেনাবাহিনী ও অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত পাঁচজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তবে নিহতের সংখ্যা আরো কয়েকগুন হবে বলেই জানা গেছে নানা মাধ্যমে। আহত হয়েছেন ও এখনো হচ্ছেন অসংখ্য গোপালগঞ্জবাসী।

কারণ ১৬ জুলাই এনসিপি নেতাদেরকে গোপালগঞ্জ থেকে পালাতে সাহায্য করার পরই সেখানে কারফিউ জারি করা হয়। যা কিছুটা বিরতি দিয়ে এখনো ( ১৮ জুলাই) চলছে।

গোপালগঞ্জে নতুন যোগ হয়েছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড। ছোট ছোট যুদ্ধজাহাজও সেখানে পৌঁছেছে। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড সেখানকার নৌ পথে তল্লাশী চালাচ্ছে যাতে কোন পুরুষ সদস্য গোপালগঞ্জ ছেড়ে পালাতে না পারে।

১৬ জুলাই থেকে জামাত- শিবিরের সদস্য ও ক্যাডারদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে কথিত যৌথবাহিনী পুরো গোপালগঞ্জে ত্রাস সৃষ্টি করছে। যাকে খুশী মারধর ও গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি পুরুষ শূন্য করার মিশনে নেমেছে ” দেশপ্রেমিক” বাহিনী। সরকারের নির্দেশ ছাড়া সেনাবাহিনী গুলি করতে পারেনা।

আর আমরা দেখেছি ১৪৪ ধারা জারি, কারফিউ জারি এর সবই প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকেই জানানো হচ্ছে। অথচ এসব জারি করার কথা সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের মানে জেলা প্রশাসকের। কিন্তু সেটি অনুপস্থিতিত দেখেছি আমরা।

হয়তো একটি অফিস আদেশ ( ডিসি অফিস) ব্যাক ডেইটে করে রাখবে নিয়ম রক্ষার জন্য।

প্রশ্ন হলো গোপালগঞ্জের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশংকা দেখা দিলে সেখানকার জেলা প্রশাসক তা আগে কেন করলেন না? দাঙ্গা- হাঙ্গামা ও নিহত- আহত হওয়ার পরে ১৪৪ ধারা? তারপরে আবার কারফিউ? আর সবই প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে? সেদিন আমরা দেখলাম ঢাকায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে গোপালগঞ্জের এই গুলিবর্ষনসহ সব ঘটনার নিয়ন্ত্রণ করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্ট লে: জে: জাহাঙ্গীর, জঙ্গী নেতা ও ক্রীড়া এবং এলজিআরডি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

সম্ভবত সেখানে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও ছিলেন। এ ব্যাপারে বিএনপি’ র প্রবীন নেতা ও সাবেক সাংসদ মেজর( অব:) আখতারুজ্জামান বলেছেন, দেশে যে পুলিশ বা অন্য বাহিনীর কোন চেইন অব কমান্ড নেই তার প্রমান হলো স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বা কমান্ড রুমে চলে গেছেন, এর চেয়ে লজ্জার আর কি হতে পারে?

শুক্রবার সন্ধ্যায় পাওয়া খবরে জানা গেছে, গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষ ও সংহিসতার ঘটনায় চলমান কারফিউর মধ্যে ১৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।

গ্রেপ্তারদের মধ্যে মুকসুদপুরে ৬৬ জন, গোপালগঞ্জ সদরে ৪৫, কাশিয়ানীতে ২৪, টুঙ্গিপাড়ায় ১৭ ও কোটালীপাড়া থেকে ১২ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। শুক্রবার বিকালের মধ্যে গ্রেপ্তারদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানোর কথা জানিয়েছেন গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মির সাজেদুর রহমান।

এই হিংসাত্মক ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার রাতে সদর উপজেলার গোপিনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহম্মেদ আলী বাদী হয়ে ৭৫ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত ৪৫০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন।

বুধবার সংঘাতের পর গোপালগঞ্জে জারি করা কারফিউ শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে তিন ঘণ্টার জন্য শিথিল করা হয়। পরে আবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৬টা পর্যন্ত চলতি কারফিউ বলবৎ রাখার ঘোষণা দেয় গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন।

আর এই কারফিউর মধ্যে নারকীয় কায়দায় বিভিন্ন এলাকায় চলছে নির্বিচারে মারধর, আটক। আটক করে কাউকে কাউকে অজ্ঞাতস্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি যা কোনভাবেই কেউ স্বীকার করছেন না।

মনে হচ্ছে গোপালগঞ্জে যুদ্ধের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি। স্থলপথের সব বাহিনী, নৌ পথের নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড নামানো হয়েছে অত্যাচার নির্যাতনের জন্য। বাকী আছে বিমান বাহিনী। হয়তো তাদেরকেও ব্যবহার করবে সরকার সময়মতো। অনেকে আশংকা করছেন, পুরো গোপালগঞ্জ পুরুষশূন্য করে জঙ্গী সরকার পরিকল্পিতভাবে বঙ্গবন্ধুর সমাধিস্থল গুড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের নীলনকশা বাস্তবায়নের অপেক্ষা করছে।

ওই যে লেখার শুরুতে বলেছিলাম ১৬ জুলাই বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি ধ্বংসের শুরু নয়, আরো আগে থেকেই। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর থেকেই পাক- মার্কন গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারি ও বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি- স্থাপনা সবই ধ্বংসের নীলনকশা করে রেখেছে।

বাস্তবায়ন করছে তাদের সময়- সুযোগমতো। এই যা পার্থক্য। আর গোপালগঞ্জের ঘটনা সফল করতে পারলে সারাদেশেই এভাবে চলবে নির্যাতন। অবশিষ্টাংশ যাতে শেষ করা যায়। আর এর ফলে জনরোষ সৃষ্টি হলে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী হবে।

তখন ইউনুস বলবেন- নির্বাচনের পরিবেশ নেই, তাই হবেনা। তার মানে এদেশবাসী যে মনে করেছিল নির্বাচিত সরকার এলে অচলাবস্থা কাটবে, সে আশায় আপাতত গুড়েবালি।

# নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, প্রাবন্ধিক, গবেষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *