শিরোনাম দেখে চমকে গেলেন কি ? হঠাৎ কেন জানি এমনটাই মনে হচ্ছিল যে এ প্রশ্নগুলো তুললে কেমন হয়, দেখিনা রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া।

দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি আমাদের সবার প্রিয় ও মান্যজন (!!) নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও সমসাময়িক রাজনীতি নিয়ে লিখবো ভাবছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে পত্রিকার একটি সংবাদে চোখ আটকে গেল।

এমন নিউজ কেন যে চোখে পড়ে , তখন আর চুপ থাকা যায় না কোনভাবেই। খবরটি ছোটই। তেমন বড় কিছু না। আবার কারো কাছে এটির কোন মূল্যই নাই। অবশ্য না থাকারই কথা।

কারণ যাদেরকে নিয়ে কথাগুলো বলা হয়েছে তারা যে আদৌ এ দেশের নাগরিক সেটিই বোধ হয় এখন আর এদেশের মানুষ মনে করেনা। প্রথম আলো পত্রিকার ২০ অক্টোবর অনলাইন এডিশনে পড়লাম— “সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলবেন না: সরকারকে মির্জা ফখরুল।”

ভাবতেই ভালো লাগে যে এখন ( আওয়ামীলেীগের অনুপস্থিতিতে) দেশের সবচেয়ে বড়দল বিএনপির মহাসচিব মহোদয় খোদ সরকারকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। যেনতেন কথা নয়।

নিউজটির ভেতরে লেখা হয়েছে – দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো ধরনের বিপদে না ফেলতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, ‘পরিষ্কার করে সরকারের উদ্দেশে বলতে চাই, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আমরা দেখতে চাই না যে আপনারা আমাদের এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের কোনো রকম বিপদের মধ্যে ফেলেছেন বা কোনো রকম সমস্যা তৈরি করছেন। এটা আমি খুব স্পষ্টভাবে আপনাদের উদ্দেশে আজকে বলতে চাই।’

গত ২০ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের ৫০ জন সদস্যের বিএনপিতে যোগদান উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করা হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমার কাছে অনেক খবর আসে। দয়া করে এই সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে কখনো হয়রানি করবেন না। তারা আমাদের সদস্য, আমাদের ভাই, আমরা তাদের পাশে আছি এবং সমস্ত শক্তি নিয়ে থাকব।’

অতীত স্মরণ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, অনেক রকম ভুল হয়েছে। অনেক রক্ত ঝরেছে বাংলাদেশে। অনেক বিভাজন হয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিএনপি জাতীয়তাবাদী দর্শন নিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে কাজ করছে বলে দাবি করেন মির্জা ফখরুল।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী ২০৩০ সালে বাংলাদেশকে একটি ‘ রেইনবো স্টেট” হিসেবে দেখতে চান। আমার বোঝার যদি ভুল না হয়ে থাকে -অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন সব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে নিয়ে একটি রাষ্ট্র দেখতে চান। বিএনপি’র মহাসচিবের এ বক্তব্যে বেশ প্রীত হলাম।

প্রীত হয়েই শুধু সবিনয়ে প্রশ্ন রাখতে চাই- বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে কি কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নাগরিককে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করবেন ? হিন্দুদের সংখ্যানুপাতে কি আপনারা তাদেরকে মন্ত্রী-এমপি বানাবেন ? সংখ্যানুপাতে কি তাদেরকে চাকরি দেবেন ? সংখ্যানুপাতে কি রাষ্ট্রদূত করবেন ? সেনাবাহিনীর প্রধান বানাবেন ? পুলিশ-নৌ-বিমান-বিজিবি’র প্রধান করবেন ?

আওয়ামীলীগ স্বৈরাচার বা ফ্যাসিষ্ট। তারাতো আর দেশে ফিরতে পারবেনা। কোন নির্বাচনও করতে পারবেনা।

সুতরাং এখন থেকে বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি-হেফাজতসহ ইসলামী জোটসমূহের প্রাধান্য থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক।

তবে একটু সবিনয়ে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই — ২০০১ সালে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায় আসে।

এরপর দেশব্যাপী সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক সহিংসতা, নির্যাতন, লুটপাট, ধর্ষণ এবং দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাসমূহ ঘটে।

এই সহিংসতার ঘটনার বেশ কিছু তথ্য বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং গবেষণামূলক প্রতিবেদনে নথিভুক্ত রয়েছে।

সহিংসতার ধরন:

১. ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন: অনেক হিন্দু নারী ও কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময় গোষ্ঠীগতভাবে সংঘটিত হয়।ভুক্তভোগীরা মামলা করতে গেলে পুলিশ সহায়তা করতে অস্বীকৃতি জানায় বা মামলা নিতে অস্বীকার করে।

২. লুটপাট ও ঘরবাড়ি ধ্বংস: হিন্দুদের ঘরবাড়ি, দোকান ও মন্দিরে হামলা, আগুন দেয়া, সম্পদ লুটপাট করা হয়। অনেক জায়গায় হিন্দুদের বাড়িঘরে ‘জায়গা খালি করো’ ধরনের হুমকি লিখে রেখে যাওয়া হয়।

৩. হত্যা ও শারীরিক নির্যাতন: হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক সদস্যকে হত্যা করা হয় বা মারাত্মকভাবে আহত করা হয়।শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান।

৪. দেশত্যাগ ও আভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি:
নিরাপত্তার অভাবে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার তাদের গ্রাম ছেড়ে আশেপাশের বড় শহর বা পার্শ্ববর্তী ভারত অভিমুখে পালাতে বাধ্য হয়।

এসব কি অস্বীকার করতে পারবেন জনাব ফখরুল ইসলাম আলমগীর?

আরেকটু পরিস্থিতি দেখে আসি। ২০০১ সালের বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের পরের সহিংস ঘটনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, হিন্দুরা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থকদের দ্বারা লক্ষ্যবস্তু সহিংসতার শিকার হয়েছিল।

তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোটের কাছে পরাজিত হয়। তারপরই শুরু হয় সহিংসতা।

যার বেশিরভাগই ঘটেছে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলাদেশে যেখানে বৃহৎ হিন্দু সম্প্রদায় ছিল। নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই হামলা শুরু হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক সম্পদ ধ্বংস করা, তা দখল করা, ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পিত আক্রমণ করেছে এসব দলের ক্যাডাররা ।

অবশ্য তখনকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তখন দেশি-বিদেশী বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচারিত এসব হামলা-সহিংসতার খবরগুলিকে অতিরঞ্জিত বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।

কিন্তু ২০০৯ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্ট ২০০১ এর নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয়। ২০১১ সালে বিচার বিভাগীয় কমিশন তার তদন্তের ফলাফল জমা দেয়।

প্রতিবেদনে ২৫ হাজার লোকের দ্বারা হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে টার্গেটেড সহিংসতার প্রমাণ পাওয়া গেছে যার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-জামায়াত-ই-ইসলামী নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের ২৫ জন মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য রয়েছে। প্রতিবেদনটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল যথারীতি প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তদন্তকে পক্ষপাতমূলক বলে অভিযোগ করেছিল।

সেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন জানিয়েছিল , ধর্ষণের সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতনের ঘটনাও উল্লেখ করা হয়েছে।

২০১১ সালে, সিরাজগঞ্জ জেলার একটি আদালত ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় পূর্ণিমা রানী শীলকে ধর্ষণের দায়ে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

** বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সাথে সাথে হিন্দুরা আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হবার পর কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে হিন্দুদের ওপর অবধারিতভাবে অত্যাচার-নির্যাতন, ঘরবাড়ি লুটপাট, শিশু-নারী ধর্ষণ, ঘর বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের মত ঘটনা ঘটতে থাকে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ও হিন্দু সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর প্রথম বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯২ সালে, ভারতে বিতর্কিত বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেবার সময়। তখন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল।

তখন ভয়েস অব আমেরিকার বাংলাদেশ সংবাদদাতা এক উষ্কানিমূলক সংবাদে বলেছিলেন- বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনায় ঢাকার মরণচাঁদ মিষ্টান্ন ভান্ডার থেকে মিষ্টিবিতরণ করেছে হিন্দুরা।

এ ধরনের ডাহা মিথ্যা ও উষ্কানিমূলক সংবাদ প্রচারের পর পরই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে প্রায় একযোগে হিন্দুদের ওপর ও তাদের সম্পত্তির ওপর ভয়াবহ হামলা-লুটপাট চলে।

এরপর হিন্দুদের ওপর বড় আকারে হামলার ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হবার পরে। তবে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার আগের সময়ে অর্থাৎ আওয়ামীলীগ আমলেও যে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার-হামলা, পুজা মন্ডপে, মন্দিরে হামলা ভাংচুর, ঘরবাড়ি লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি তা কিন্তু নয়।

তবে সেটি বিএনপি আমলের চেয়ে কম ছিল। তাই বলে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারি দল হিসেবে পরিচিত দল হিসেবে আওয়ামীলীগও এই ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ও অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে পারেনা।

এর মধ্যে হিন্দুদের ওপর হামলার অভিযোগ আসে গত ২০২৪ এর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। হিন্দুদের একটি সংগঠন জাতীয় হিন্দু মহাজোট এক পরিসংখ্যানে মাধ্যমে দাবি করেছেন, শেখ হাসিনার পতনের পরে ৪৮টি জেলায় ২৭৮টি হামলার ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদ দাবি করছে, ৫২টি জেলায় অন্তত ২০৫টি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও উপাসনালয়ে হামলার ঘটনা তদন্তে ‘সংখ্যালঘু কমিশন’ গঠনের দাবি জানিয়েছে ‘সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠন।

গত চব্বিশের আগষ্টে এসব হামলা-নির্যাতনের ঘটনার পর বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেছিলেন, হিন্দুর ওপর হামলার ক্ষেত্রে এক ধরনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে।

এসব হামলার সাথে যারা জড়িত ছিল অতীতে তাদের বিচার কখনো হয়নি। ফলে এটি থামানো যাচ্ছে না। “তারাই হিন্দুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা ধর্মীয় সহাবস্থানে বিশ্বাস করেন না।” তিনি বলেন এই ধারা পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে।

তিনি এও বলেছেন, গত ১৫ বছর যাবত আওয়ামী লীগ সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদন্নোতির ক্ষেত্রে ‘অতীতের বৈষম্য’ দূর করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অনুপাত মোট জনসংখ্যার আট শতাংশ। কিন্তু সে অনুপাতে নিয়োগ ও পদোন্নতি হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“যখন সংখ্যালঘুদের দেখা গেল, তখন আবার চিৎকার শুরু করলো যে সংখ্যালঘুরা তো সব খেয়ে ফেলছে”—এই হলো পরিস্থিতি।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা রানা দাশ গুপ্ত বলেন, চব্বিশের আগষ্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে এখনো যেসব হামলা হচ্ছে হিন্দুদের ওপর সেগুলোর সাম্প্রদায়িক মাত্রা ভয়াবহ।

কেউ কেউ রাজনৈতিক রং দেবার চেষ্টা করছেন এই সাম্প্রদায়িক হামলাকে কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই বিষয়টিকে শুধু রাজনৈতিক মাত্রা দেবার সুযোগ নেই।

তিনি প্রশ্ন করেন -চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি কি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন? তাহলে তার বাড়ি কেন গুড়িয়ে দেয়া হলো ?” তাহলে এ ধরনের হামলাকে কি সাম্প্রদায়িক হামলা-সহিংসতা বলবেন না ?

** আবার একটু আমাদের বিএনপি মহাসচির মির্জা ফখরুলের কথায় ফিরে আসি।

বিএনপি নেতাসহ বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতারাই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ধর্মীয় নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বেশ মধুর মধুর কথা বলেন।

তারা বলেন- আপনারা কোনভাবেই নিজেদেরকে ‘ সংখ্যালঘু ‘ বলবেন না। সব ধর্মের নাগরিকের সমান অধিকার। রাষ্ট্র-সংবিধান আপনাদেরকে সেই অধিকার দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সত্যিই কি তাই ?

রাজনীতিবিদ, সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টারা যত মধুর মধুর কথাই বলুন না কেন আসলে তো এসব ধর্মের নাগরিকরাতো সংখ্যার দিক থেকে সংখ্যালঘুই।

আর মির্জা ফখরুল কিন্তু মতুয়া সম্প্রদায়ের নাগরিকদের বিএনপিতে যোগদান উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তাদেরকে “সংখ্যালঘু” হিসেবেই অভিহিত করেছেন।

“সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলবেন না: সরকারকে মির্জা ফখরুল।” – এ কথার পরে আর কোন কিছু বলার প্রয়োজন আছে ? আচ্ছা সংখ্যালঘুদেরকে কি শুধু এখনকার সরকারই বিপদে ফেলেছে ? বাংলাদেশে হেন কোন রাজনৈতিক দল আছে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিপদে ফেলেনি ?

১৯৯১ নির্বাচনের আগে বৃহত্তর চট্টগ্রামে এক নির্বাচনী প্রচারনাকালে বিএনপি চেয়ারপারসন ম্যাডাম খালেদা জিয়া দেশবাসীর উদ্দেশ্যে হুশিয়ারি উচ্চারন করে বলেছিলেন- আওয়ামীলীগকে ভোট দিলে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশের ফেনীপর্যন্ত ( তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও ফেনী) ভারতের প্রদেশ হয়ে যাবে, মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি বাজবে ।

আমার স্মৃতিবিভ্রম না হলে এমনটিই বলেছিলেন তিনি। সে সময়কার সংবাদপত্র খুঁজলেই তার প্রমান পাওয়া যাবে। ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগ জিততে পারেনি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যায়। কিন্তু তারপরে কি ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে গিয়েছির , নাকি মসজিদে উণুধ্বনি শোনা গিয়েছিল ?

এটাই কি অসাম্প্রদায়িক বিএনপি জনাব মির্জা ফখরুল ইসলাম খুব জানতে ইচ্ছে করে। তাহলে ম্যাডাম জিয়া ২০৩০ সালে যে “ রংধনু স্টেট” করতে চান বাংলাদেশকে –সেটি কি এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব দৃঢ়ভাবে ধারন করে ?

**নির্বাচনী হাওয়া এলেই হিন্দুরা বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয় কেন ?

সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের ৫০ জন সদস্যের বিএনপিতে যোগদান উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল বিএনপির উদ্যোগে। প্রশ্ন জাগে নির্বাচনী প্রচারণা বা নির্বাচনকে সামনে রেখেই কেন হিন্দু-বড়ুয়া-খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা বিএনপিতে-জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন ?

গত ১৪ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার ২৫ জন ‘সনাতন’ ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছেন। এ খবরটিও মনে আছে নিশ্চয় আপনাদের।

সেদিন বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর জেলা কার্যালয়ে প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণ করে হিন্দুরা যোগ দিয়েছে এমনটিই জানা গেছে। সেই অনুষ্ঠানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক সাংসদ লতিফুর রহমান বলেছেন, ‘সনাতন’ ধর্মাবলম্বীরা স্বপ্রনোদিত হয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতিতে যোগদান করেছেন।

“আমাদের রাজনীতি নীতি, আদর্শ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। তাদের এ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে মানুষ আদর্শভিত্তিক রাজনীতির প্রতিই আস্থা রাখে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ২৫ জন জামায়াত ইসলামীতে যোগদান করেছেন । আগামীতে আরো অনেকেই যোগ দেবেন।”

এই যে বিএনপি-জামায়াতে হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের যোগদান তা এত ফলাও করে প্রচার করার কি আছে তা ঠিক বুঝিনা। কারণ আওয়ামীলীগকে, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ, বাসদ বা অন্য কোন দলকে এমন কিছু করতে দেখিনি। বাংলাদেশের যে কোন ধর্মের নাগরিকই যে কোন রাজনৈতিক দল করার অধিকার রাখে নিশ্চয় যদি আইনগত কোন বাধা না থাকে। তাহলে এই প্রচার ঠিক কাদের দৈণ্যতা – যারা দলে যোগদান করলেন তাদের না যে দলে যোগদান করলেন তাদের ?

আমাদের একমাত্র নোবেল লরিয়েট যাকে নিয়ে আমাদের গর্বের সীমা নাই ( দুর্মুখেরা যাই বলুক না কেন ) সেই মহানুভব প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস গত ১৬ সেপ্টেম্বর শান্তি-সম্প্রীতি-নিরাপত্তা- নাগরিক অধিকারের বার্তা নিয়ে গিয়েছিলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে।

তিনি সেখানে অনেক কথার মধ্যে বললেন-“ ধর্ম নিয়ে যত পার্থক্যই থাকুকনা কেন রাষ্ট্র আমাদের প্রতি পার্থক্য করতে পারবেনা। কারণ রাষ্ট্র দায়বদ্ধ। যে যে ধর্ম-মতবাদেই বিশ্বাস করুন না কেন রাষ্ট্রের কাছে সে নাগরিক। সংবিধানেই সেই নাগরিকের অধিকার দেয়া আছে।

সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা আছে অধিকার। কোন অধিকার নাই রাষ্ট্রের কারো প্রতি বৈষম্য করার। কাজেই যত কথাই বলি নাগরিক হিসেবে অধিকার দিতে হবে.. ইত্যাদি ইত্যাদি।”

সেই একাত্তর সাল থেকে অদ্যাবধি এদেশে বসবাসকারি হিন্দুদের প্রাণ বাঁচানো , মান সম্মান, নারীদের সম্মান রক্ষা যে বড় দায়! তাই কারো আশ্বাসে আর এখন বিশ্বাস নেই এ বাংলার হিন্দুদের তথা সংখ্যালঘুদের। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের কোন ভবিষ্যৎ নেই, বন্ধুও নেই।

# ইশরাত জাহান, প্রাবন্ধিক, লেখিকা ও নারী অধিকার সংগঠক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *