বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীই কি এদেশের রাজনীতি-প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের ষড়যন্ত্রে মেতেছে ?
এমন ভীতিকর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই বাংলাদেশে।
একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জন পরবর্তী পঁচাত্তরে জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংস-বর্বরতম হত্যাকান্ড সংঘটিত হলো।
এর মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের দোসর পাকিস্তান ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সবচেয়ে বড় প্রতিশোধটি নিয়েছে।
তারপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামী নানা কূট-কৌশলে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে।
জামায়াতে ইসলামীর সৃষ্টি হয়েছে তৎকালীন পশ্চিম পকিস্তানে। কিন্তু সেই দলের নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী নিষিদ্ধ হয়েছিলেন পাকিস্তানেই অনেক আগে পবিত্র ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা দেয়ার জন্য।
এই মওদুদী ইসলামের নানা অপব্যাখ্যাকারি। আর তার হাতেগড়া রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু এরাই পবিত্র ইসলামের নামে গতবছর জুলাই-আগষ্টে ‘জঙ্গী ক্যু’ এর পর থেকে অনেকটা নিয়ন্ত্রন করছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বেই ইসলামী দলগুলো বলতে গেলে সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন নিয়ন্ত্রন করছে।
এমনকি সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল আমেরিকার ক্রীড়ানক বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকার প্রধান ড. মুহম্মদ ইউনুসও এই জামাতে ইসলামীর পরামর্শমতো চলছেন।
২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট কথিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী অনেকটা জোর করে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে আকাশপথে ভারতে পাঠিয়ে দিলো।
তারপর সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন, যাতে নৌ ও বিমান বাহিনী প্রধানও উপস্থিত ছিলেন।
তখন তিনি রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে জাতির এই ক্রান্তিকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে আলাপ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে যে রাজনৈতিক দলের নামটি বলেছিলেন-সেটি ছিল জামায়াতে ইসলামী।
স্বাভাবিকভাবে তখন বুঝে নিয়েছিলাম এই কথিত ছাত্র-গণ অভ্যুত্থানের পেছনে কোন রাজনৈতিক অপশক্তি ও অপশক্তিগুলোর শক্ত অবস্থান রয়েছে।
সেই ’২৪ এর আগষ্ট থেকে বর্তমান ’২৫ এর জুন পর্যন্ত যা আলামত দেখা যাচ্ছে তাতে একাত্তরের খুনী জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী জঙ্গী দলগুলোর আস্ফালন দেখলেই বোঝা যায় কাদের আধিপত্য চলছে বাংলাদেশে।
এদিকে গত ১৪ জুন জামায়াতে ইসলামী এক বিবৃতিতে অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডনে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক ও যৌথ বিবৃতিতে উষ্মা প্রকাশ করেছে।
দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে দেখা যায় তাতে বলা হয়েছে- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে বিদেশে বসে যৌথ বিবৃতি দেয়ার মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন হয়েছে।
দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয় সম্পর্কে যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে একটি দলের প্রতি প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুন্ন করেছে।
একই সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ প্রেস ব্রিফিং করায় আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়ে জনগণের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেছে জামায়াতে ইসলামী।
গত শনিবার (১৪ জুন) সকালে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর এ অভিমত ব্যক্ত করেছে দলটি।
দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে জামায়াতে ইসলামী তাদের এ উষ্মা প্রকাশ করেছে।
জামায়াতের নেতারা যে কি পরিকল্পিতভাবে এগোচ্ছে রাজনীতিতে তা তাদের এক নেতার বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় খানিকটা।
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেছেন, “ জামায়াত এখন ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে।”
গত ৯ জুন দুপুর পাবনার আটঘরিয়া উপজেলা জামায়াতের ঈদ পুণর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নির্বাচন কমিশন এখনো নির্বাচনের কোন তারিখ ঘোষণা দূরে থাক আদৌ কবে নির্বাচন হবে, কোন কোন দল নির্বাচন করতে পারবে তারও কোন পাত্তা নেই।
এমনকি কবে নাগাদ নির্বাচন হবে, আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে যখন অন্তবর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কোন বোঝাপড়া হয়নি তখন জামায়াতে ইসলামী কিন্তু দেশের ৩০০ টি আসনে তাদের প্রার্থী মোটামুটিভাবে ঠিক করে রেখেছে বলে প্রচার করছে।
যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে দেশটি স্বাধীন হলো রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সেই দলটিকেই নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচন নির্বাচন খেলা খেলতে চাইছে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার , বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কিছু গোষ্ঠী ?
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক অনেক সীমাবদ্ধতা-ভুল থাকতে পারে এটি অনস্বীকার্য।
কিন্তু এদেশে মানুষের ভাতের অধিকার ,উন্নয়ন ও বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে এই দলটির ভূমিকাকে অস্বীকার করা মানেতো বাংলাদেশকেই অস্বীকার করা।
অবশ্য জামায়াতে ইসলামীসহ তাদের করায়ত্ব ইসলামী দলগুলো, টোকাইদের নবগঠিত দল এনসিপিতো একাত্তরকেই অস্বীকার করে বসে আছে।
তবে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতারা দেশের বিভিন্ন স্থানে সফরকালে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করতে শুরু করেছেন।
এরই মধ্যে গত ১৩ জুন চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির, কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য ও সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।
এদিন সকালে সাতকানিয়া উপজেলার কেরানীহাটের একটি রেস্টুরেন্টের হলরুমে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা জামায়াতে ইসলামী আয়োজিত ‘চট্টগ্রাম-১৫ আসনের প্রার্থী ঘোষণা ও দায়িত্বশীল সমাবেশে’ এই ঘোষণা দেন দলের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
গোলাম পরওয়ার জানান, জামায়াত ৩০০ আসনে প্রার্থী প্রস্তুত রেখেছে। এ নিয়ে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি-এই পাঁচ জেলার ২৩টি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করলো জামায়াত।
এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা তাদের ছবি সম্বলিত রঙ্গিন পোষ্টার সেঁটে দেয়া শুরু করেছে দেয়ালে দেয়ালে।
তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় জামায়াত যদি এককভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে এবং সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হয় তাহলে তারা ৫ থেকে ১০ টি আসনের বেশি পাবেনা।
কিন্তু তারা প্রচার-প্রচারণায় অন্য যেকোন দলের চেয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করে মাত্র। তবে জামায়াতে ইসলামী সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক তা কখনোই চায়না।
কারণ দলটি সবসময়েই ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে তাদের সমর্থিত লোকজনকে বসিয়ে দিয়ে ক্ষমতার মধূ খেতে চায়।
২০০১ সালে বিএনপির সাথে জোট বেঁধে তারা ক্ষমতার মধু খেয়েছে। এবারো তারা বিভিন্ন ইসলামী দলগুলোর সাথে ঐক্য করে জোট বাঁধতে চায়।
পাশাপাশি বিএনপি ও এনসিপির সাথে নানা হিসেব নিকেশ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায়।
কিন্তু বিএনপি এবার আর জামায়াতকে সাইড দিতে চাইবে বলে মনে হয়না। জামায়াতে ইসলামী গনতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির চেয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় তাদের লোক বসিয়ে ক্ষমতার মসনদে যেতে বেশি আগ্রহী।
কারণ আওয়ামীলীগসহ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জামায়াত পাত্তা পাবেনা সেই নির্বাচনে-এটি তারা নিজেরাও বেশ ভালোভাবে জানে।
তাই ক্ষমতার মসনদে যেতে তারা নানা ফন্দি-ফিকির করছে। তবে বাংলাদেশের রাজনীতির তরী কোন দিকে ভাসবে আর তা কোথায় নোঙ্গর করবে সেজন্য আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
# ইশরাত জাহান, লেখিকা, প্রাবন্ধিক