অধ্যাপক অর্থনীতির। কিন্তু নোবেল পেলেন শান্তিতে। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ড. ইউনুস বলে কথা ! আসলে পেলেন না নানা কায়দায় দেন দরবার করে , তৈল মর্দন করে বাগিয়ে নিলেন সেটাও প্রশ্ন অনেকের কাছে। ক্ষুদ্র লোন দিয়ে দেশে বিদেশে কোথায় এই ড. ইউনুস শান্তি এনেছেন তা আসলে কেউই জানেনা। কিন্তু তিনি নোবেল পুরষ্কার পেলেন এবং তা পাওয়ার পর নানা বন্দনা শুরু হয়ে গেলো বাংলাদেশে। আর তার ঠিক পাশের দেশ মিয়ানমার বা মায়ানমার বা বার্মা যাই বলিনা কেন সেখানকার এক নেত্রী অং সাং সুকি বা সুচি তিনিও শান্তিতে পেয়েছিলেন নোবেল। পাশাপাশি দুই দেশের দুই নোবেল লরিয়েট । দুজনেই শান্তিতে।
কিন্তু তাদের কোন দেশেই কোন শান্তি নেই। বরং চরম আশান্তি।নানা অত্যাচার-নিপীড়নে জনগণের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। দু’দেশই চরম অশান্তির মধ্যে। সাধারন জনগণ হাসফাঁস করছে গণতন্ত্র নামের সোনার হরিণ ও একটুখানি শান্তির জন্য। এই দুই দেশের জনগণ কি এদের এই শান্তির নোবেল ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবে ?
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমার দেশটির সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ করে সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। তবে তারা কিন্তু এখনও স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেনি। তবে তাদেরকে বিভিন্ন বিদেশী গোষ্ঠী নানাভাবে সাহায্য সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই আরাকান আর্মি সেখানকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সেখান থেকে বিতারিত করে দিয়েছে।
এই রোহিঙ্গা দলে দলে এসে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে , বা বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার তাদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে ও দিচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নামে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে।লাখে লাখে রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে কেউ হয়ে গেছেন ‘মানবতার জননী’খ্যাত শেখ হাসিনা, আবার বর্তমানে কেউ নতুন করে মানবতার নতুন ফেরিওয়ালা সাজছেন। কিন্তু এই ফাঁকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী. আন্তর্জাতিক ইসলামী সন্ত্রাসী সংগঠন লষ্কর-ই-তৈয়বা, কওমী মাদ্রাসা ভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন ইসলামী বিচ্ছিন্নতাবাদি সংগঠন তাদের শক্তি মজবুত করেছে। শুধু করছে নয় , এখনও তাদের শক্তি বাড়াচ্ছে এসব রোহিঙ্গা ইসলামী নাগরিকদেরকে সশস্ত্র ট্রেনিং দিয়ে।
আর বাংলাদেশের বর্তমান অনির্বাচিত কথিত অন্তবর্তী সরকার প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারতো রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের সাহায্য পাঠানোর নামে রাখাইন সীমান্তবর্তী বাংলাদেশকে ‘ মানবিক করিডোর’ দিয়েই বসেছেন। জাতিসংঘের ছদ্মাবরনে কোন পরাশক্তি এই কথিত মানবিক করিডোর ব্যবহার করছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর তা ব্যবহার করে শুধু যে রাখাইন রাজ্যে তাদের ঘাঁটি গেড়ে বসবে তা কিন্তু নয়। এরা বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত তাদের সামরিক-বেসামরিক ও বানিজ্যিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সব ধরনের কৌশলই নিয়েছে।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি বর্তমানে ভারতে আশ্রিত তিনি সরাসরি বলেই দিয়েছিলেন যে, তিনি যদি বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিনস দ্বীপসহ কিছু অংশে মার্কিনীদের ঘাঁটি করতে অনুমতি দিতেন তাহলে তাকে আজীবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে রাজী না হওয়ায় একটি ‘ মেটিকুলাস ডিজাইন’ এর মধ্য দিয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণে এ বিষয়টি বুঝতে খুব বেশি একটি অসুবিধে হওয়ার কথা নয় সামান্য রাজনীতি সচেতন নাগরিকদের জন্য।
অনেকেই বলছেন, এশিয়ার এ অঞ্চলে সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগে থেকেই চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। তা তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ডেমোক্রেট বা রিপাকলিকান যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন। সেক্ষেত্রে শুধু তাদের কৌশল পাল্টায় মাত্র, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা কিন্তু তাদের থেকেই যায়।
সাবেক বাইডেন প্রশাসনের আমলে নোবেল লরিয়েট ড. ইউনুসের মাধ্যমে নানা কৌশলে আওয়ামীলীগ সভানেত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও দেশছাড়া করার মধ্য দিয়ে তার ভিত্তি স্থাপন হয়ে গেলো। আর মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী হয়ে এবার সেই ভিত্তির ওপর ইমারত নির্মানে হাত দিয়েছেন। এজন্য অবশ্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিভিন্ন দেশকেও সঙ্গে নেয়া হচ্ছে এই ইমারত নির্মান যাতে নিরবচ্ছিন্ন ও নিরাপদ করা যায়। তাই কেউ যদি মনে করে থাকেন বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেই, তাহলে বাংলাদেশের দেশান্তরী ( জোর করে পাঠিয়ে দেয়া) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার একই কায়দায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এনে ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হবে সেটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই হবেনা। কারন ড.ইউনুসের মত একজন প্রতিহিংসাপরায়ন, অর্থলোভী ও ক্ষমতালোভী নোবেল লরিয়েট শুধুমাত্র তার নিজের শান্তি বজায় রাখার জন্য অন্য যেকোন আশান্তি তিনি যে কাউকেই করতে দিতে রাজী আছেন।
যার উদাহরণ হলো ক্ষমতায় বসেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতকে উদ্দেশ্য করে সেভেনে সিস্টারর্স সম্পর্কে হুমকি দেয়া, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শত্রæ পাকিস্তানের সাথে গলায় গলায় বন্ধুত্ব, তাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর, ভারতের চিকেন নেক’র কাছে বাংলাদেশ অংশে উর্ধ্বতন পাকবাহিনীর কর্মকর্তাদের সফর, চীনকে সেখানে বিমান বন্দর গড়তে অনানুষ্ঠানিক সম্মতি দেয়া ইত্যাদি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া চীনকে অতিমাত্রায় প্রশ্রয় দিয়ে ভারতকে ঠেকাতে অতিবেশি বন্ধুত্ব গড়ে তোলার প্রয়াসটি অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবেই প্রকাশিত আজ জনগণের কাছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারি দল আওয়ামীলীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে অনেক আগেই নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে ইউনুস সরকার। অতিসম্প্রতি আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার পায়তারা হিসেবে নানা নাটক মঞ্চস্থ করা শুরু হয়েছে। তাও করানো হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বিভিন্ন ইসলামী দল ও গত জুলাই-আগষ্টের কথিত ‘ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি ( এনসিপি)’র মাধ্যমে। এজন্য ড. ইউনুসের রাষ্ট্রীয় আবাসস্থল ‘যমুনা’র সামনে গণ অবস্থান যা পরবর্তীতে রাজধানী ঢাকার শাহবাগে স্থানান্তরিত হয়েছে। সেখান থেকে জানানো হচ্ছে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে এর সবকিছুই করা হচ্ছে রাখাইনের ‘মানবিক করিডোর’, বাংলাদেশে জাতিসংঘের ছদ্মাবরনে মার্কিন সামরিক শক্তির প্রবেশ, চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের নামে মার্কিন নৌসেনাদের উপস্থিতি থেকে সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টি ফেরানোর জন্য। সেই দৃষ্টি ফেরাতে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দেশত্যাগের পর তা নিয়ে বিতর্ক তোলা, নারায়নগঞ্জের সাবেক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভি’কে গ্রেপ্তারসহ নানা ধরনের বিষয়কে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। এমন আরো অনেক কিছুই হয়তো সামনে আনবেন বাংলাদেশে ‘ মেটিকুলাস ডিজাইন’ এর মূল স্রষ্টা ড, ইউনুস।
কয়েকমাস আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এক অনুষ্ঠানে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মো: মাহফুজ আলমকে তিনি ২০২৪ এর আগষ্ট অভ্যুত্থানের সেই ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ এর অন্যতম প্রধান কারিগড় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে এটি পুরোটাই ছিল ‘ মেটিকুলাস ডিজাইন’ এর অংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশে কথিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যেসব হত্যাকান্ড, পুলিশ হত্যা, মেট্রোরেলে আগুন দেয়া, পুলিশকে নির্মমভাবে হত্যা করে প্রকাশ্যে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা , প্রায় একই সময়ে সারাদেশের পুলিশ স্টেশনগুলোতে হামলা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া , কয়েক হাজার পুলিশ হত্যাসহ নারকীয় তান্ডব চালানো সবই এই মেটিকুলাস ডিজাইনের অংশ হিসেবেই করা হয়েছে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায়। সবই কিন্তু এই নোবেল লরিয়েট ড. ইউনুসের দুরবর্তী অংশগ্রহণ বা নির্দেশের মাধ্যমেই হয়েছে। শান্তিতে নোবেল পাওয়া লোকটি কি সুন্দরভাবে একটি দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলো ভাবুনতো !
অপরদিকে মিয়ানমারে একসময়কার গণতন্ত্রের মানসকন্যা অং সাং সুচী এই যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্টির ওপর মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দমন পীড়ন নীতি সে ব্যাপারে কোন কথাই বলছেন না। অথচ মার্কিন মদদপুষ্ট হওয়ার কারণে একসময়ে তাকে মানবতার কন্যা, গণতন্ত্রের কন্যা বা ত্রাতা হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।
দীর্ঘদিন তিনি সামরিক জান্তার নির্যাতন, গৃহবন্দীত্বও বরণ করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনিও শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পেলেন। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী হামলায় অসংখ্য নারী-শিশু ও বেসামরিক লোক নির্বিচারে মারা গেলো। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো মিয়ানমারের শান্তি পুরষ্কারপ্রাপ্ত অং সাং সুচী ও বাংলাদেশের শান্তিুতে নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনুস এ বিষয়ে একেবারেই নীরব। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার কি অশান্তির জন্য ? আর পশ্চিমা দেশের তল্পিবাহক হলেই বোধ হয় শান্তিতে নোবেল জুটে যায় তা তারা যত অশান্তিই সৃষ্টি করুন না কেন !
#রাকীব হুসেইন, লেখক, গবেষক।