বাংলাদেশে রাজনীতির মাঠে গণেশ উল্টে যাচ্ছে! এমন জল্পনা- কল্পনাই চলছে গত কয়েকদিন ধরে। সশস্ত্রবাহিনী এতদিন অনেকটা চুপ করে থাকলেও তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে শুরু করছেন বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে। বর্তমান অবৈধ-অনির্বাচিত- অগণতান্ত্রিক ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতীকালীন সরকারের সাথে সশস্ত্র বাহিনীর বিরোধ এখন চরমে। তেমনি বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও ফুঁসে উঠছে ইউনুস সরকারের বিরুদ্ধে। অবশ্য শুধু বাংলাদেশের সশস্র বাহিনী বা কিছু রাজনৈতিক দলের বিরোধীতায় নয়। এর পেছনে চীন- ভারত- রাশিয়া’ রও চাপ রয়েছে। ভূরাজনৈতিক এ চাপে পড়ে বাংলাদেশের ‘ রাজনৈতিক- সামরিক’ গণেশ উল্টে যাচ্ছে বলেই পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।

বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে রাখাইন রাজ্যে কথিত মানবিক করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনার দায়িত্ব বিদেশী প্রতিষ্ঠানের হাতে ছেড়ে দেয়া- এ দুটি বিষয়ে সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক দলসমূহতো বটেই সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যেও চরম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বুধবার ২১ মে স্পষ্টত বলেই দিয়েছেন, আগে দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ রক্ষা করেই যা করার করতে হবে। কারণ সশস্ত্রবাহিনী সাংবিধানিকভাবে দেশ রক্ষা ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিয়েই শপথ নিয়েছে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহের অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করার বিষয়েও তারা সংকল্পবদ্ধ।

অপরদিকে হঠাৎ করেই ইউনুস সরকারের পক্ষ থেকে বুধবার এক সংবাদ সম্মলনে জানানো হয় তারা আপাতত: ‘ মানবিক করিডোর’ নিয়ে কোন আলাপ- আলোচনা করছেনা। তারমানে বাংলাদেশের সশস্র বাহিনীর কোন সমর্থন না পেয়ে ” পাল্টি খেয়েছে” ( হঠাৎ করে উল্টে যাওয়াকে বাংলা ভাষায় এভাবেই সমালোচনা করা হয়)।

সেনা সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো থেকে যা জানা গেলো তা হলো- বুধবার তিনবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বিত বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ্জামান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল সদস্যদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিরলস প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, কিছু স্বার্থান্বেষী মহল—দেশীয় ও আন্তর্জাতিক—সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর অভিযোগ তুলে বাহিনীকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করছে। আমাদের তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। যেহেতু পুলিশ ও প্রশাসন নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে এবং সেনাবাহিনীই শেষ ভরসা, তাই এসব মহল ইচ্ছাকৃতভাবে সেনাবাহিনীকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চায়, যাতে তারা নিজেদের অসাংবিধানিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে।

সেনাপ্রধান বলেন, সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ ইত্যাদি নানা মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এমনকি কখনও কখনও কর্মকর্তাদের হয়রানিও করা হচ্ছে, অথচ এসব বিষয়ে সেনা সদর দপ্তরকে যথাযথভাবে অবহিত করা হচ্ছে না। এ ধরনের বিষয়গুলো সম্পূর্ণরূপে সেনা সদর দপ্তরের আওতাধীন এবং ভবিষ্যতে এসব বরদাস্ত করা হবে না। তিনি বলেন, বর্তমানে তিনি এমন এক অবস্থানে আছেন যেখানে তাঁর কোনও অভিভাবক নেই।

সেনাপ্রধান বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরাপত্তা সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেনাবাহিনীর সাথে পরামর্শ না করেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, মানবিক করিডোর খোলা কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর অন্য কারো কাছে হস্তান্তরের মতো প্রস্তাব সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। এসব সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র একটি নির্বাচিত সরকারই নিতে পারে। সেনাপ্রধান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সেনাবাহিনীকে অন্ধকারে রেখে। এমনকি জাতিসংঘে সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর চিঠিও পাঠানো হয়েছে সামরিক কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে এবং ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারিতে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। দেশের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করবে একটি বৈধ, নির্বাচিত সরকার—কোনও অনির্বাচিত প্রশাসন নয়।

একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা ব্যারাকে ফিরে যাই, কারণ আমরা এখন জনরোষ, ডাকাতি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঠেকাতে পারছি না এবং এতে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। উত্তরে সেনাপ্রধান বলেন, আমরাও এই কথা ভেবেছি, কিন্তু এখনই সেনা প্রত্যাহার করলে সাধারণ জনগণের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। কর্নেল পদমর্যাদার একজন অফিসার জোর দিয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতীয় মর্যাদা কোনও অবস্থাতেই আপসযোগ্য নয়—এগুলো রক্ষার বিষয়টি অমার্জনীয়।

এ পর্যায়ে এক কর্মকর্তা উঠে দাঁড়িয়ে সেনাপ্রধানকে বলেন, অফিসার কোর (Officer Corps) সেনাপ্রধানের পেছনে ঐক্যবদ্ধ এবং যেকোনো আদেশ পালনের জন্য প্রস্তুত– এমনটাও জানা গেছে।

সশস্ত্রবাহিনীর এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সেনাপ্রধান বলেন, সেনাবাহিনী আর কোনো জনতার বিচার বা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ সহ্য করবে না। তিনি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণের ইঙ্গিত দেন। তিনি CGS-কে নির্দেশ দেন যেন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যাতে আর কোনো গণ-অপব্যবহার বা পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর হুমকি না দেওয়া হয়।

সেনাপ্রধান বলেন, কিছু অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ও সৈনিক মিথ্যা দাবি করছেন যে তারা রাজনৈতিকভাবে হয়রানির শিকার। তিনি বলেন, যেসব শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে তারা চাকরি হারিয়েছেন, সেইসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হবে। আরও বলেন, কিছু অবসরপ্রাপ্ত স্বার্থান্বেষী অফিসার বর্তমানে কর্মরত অফিসারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ ছড়াচ্ছেন, যার উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীকে কলুষিত করা। এসব কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না। এমনকি কিছু রাজনৈতিক নেতা সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের “ভারতের দালাল” আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। সেনাবাহিনী একটি দেশপ্রেমিক প্রতিষ্ঠান এবং দেশের স্বার্থেই দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে।

সেনাপ্রধান আরও বলেন, কিছু কর্মকর্তা পদোন্নতি বা ভালো পদের জন্য নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করছেন। এ ধরনের আচরণকে অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে দেখা হবে। শেষ মুহূর্তে সকল কর্মকর্তা একসাথে করতালি দিয়ে সেনাপ্রধানকে মনোবল ও নৈতিক সমর্থন জানান।

মূলত: সশস্ত্রবাহিনীর কর্মকর্তাদের এমন এমন অভিপ্রায় জেনে অথর্ব ইউনুস সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান দাবি করেছেন, মানবিক করিডোর নিয়ে সরকার চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি। বুধবার তড়িঘড়ি করে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত নিলে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সাথে কথা বলেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। অথচ মাত্র ২০/২৫ দিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন সরকার মানবিক করিডোর দিতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এখন আবার একেবারে ইউটার্ন দিচ্ছে অবস্থা বেগতিক দেখে।

#ইশরাত জাহান, লেখিকা, মানবাধিকার পর্যবেক্ষক।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *