অত্যন্ত চতুর এক নাট্যকার- স্ক্রিপ্টরাইটার- অভিনেতা তিনি। বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদ, সামরিক- বেসামরিক আমলা সবাইকেই ঘোল খাইয়ে ছাড়লেন। তাঁর হাব-ভাবে দেখাচ্ছিলেন যে তিনি আর এক মুহূর্তও বাংলাদেশে আপাতত: সবচেয়ে ক্ষমতাধর চেয়ারটিতে আর বসে থাকতে রাজী নন। কিন্তু চেয়ারের সাথে তাঁর পশ্চাৎদেশ যে সুপারগ্লু দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি তা আর বুঝতে বাকী নেই কারো।
প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী- প্রতিহিংসা পরায়নপর মহান এই ব্যক্তিটি আর কেউ নন। শান্তিতে নোবেল পাওয়া প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস। বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদটি এমনভাবে এই মহান(!) ব্যক্তিটিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে যে তা বলাই বাহুল্য। ২১ মে থেকে যা চলছে দেশের সর্ব্বোচ্চ মহলে তা দেখে এমন ধারনাটি বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে সত্যিই ড. ইউনুসের মত এমন ‘ কূট-নাগরিক নেতৃত্ব ‘ পাওয়া যাবেনা।
কথিত মানবিক করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশী ( মার্কন) অপারেটরের হাতে তুলে দেয়াসহ দেশকে পুরোপুরি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সব প্রচেষ্টাই তিনি এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছেন। তবে তার সেই বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছে বাংলাদেশের সশস্র বাহিনীর সর্ব্বোচ্চ কর্মকর্তাগণ। যদিও গত বছর কথিত আগষ্ট অভ্যুত্থানের পর থেকে সশস্র বাহিনীই ড. ইউনুসকে ওই পদে থাকতে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছে।
কিন্তু ক্ষমতায় বসে ড. ইউনুস তার পারিষদবর্গ ও কথিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র নেতারা সারাদেশে যে অরাজকতা চালিয়ে যাচ্ছেন তাতে এরই মধ্যে অতীষ্ঠ হয়ে উঠেছে দেশবাসী। এমনকি চব্বিশের জুলাই- আগষ্ট অভ্যুত্থানের হার্ডকোর নেতাকর্মী- সমর্থকদের অনেকেই এখন তাদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক বন্ধন- মূল্যবোধ, দেশের সহিষ্ণু রাজনীতি, অর্থনীতি সবই শেষ।
এমনতরো একটি অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে সশস্র বাহিনীর তিন প্রধান গত ২১ মে সেনা কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময় ( সেনা ভাষায় দরবার) সভায় দেশবিরোধী কোন চুক্তি ( করিডোর, বন্দর) না করার পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। পাশাপাশি এবছর ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথাটি জোর দিয়ে বলেছেন। মজার বিষয় হলো- সশস্র বাহিনী চাইছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে।
অপরদিকে বেসামরিক নাগরিক ড. ইউনুসসহ তার অনুসারিরা নির্বাচন চাইছেনা। এরমধ্যে গত ২২ মে রাতে সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামসহ বৈষম্যবিরোধী কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি নাকি পদত্যাগ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এমনটাই বলেছেন সংবাদমাধ্যমকে নাহিদ ইসলাম। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তিনি ও তার ‘টোকাই সাবেক ছাত্রনেতা’রা একধরনের ” পদত্যাগ নাটক” করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইছেন।
এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা- প্রাবন্ধিক মঞ্জুরুল হক লিখেছেন, জ্বি না, মোটেও তিনি পদত্যাগের কথা ভাবছেন না। চিবিয়ে রস খেয়ে ফেলে দেওয়া আখের ছিবড়ে থেকেও রস বের করতে জানেন তিনি। এত সহজে বড় মাঠের খেলোয়াড় মাঠ ছাড়বেন না।এখন বাচ্চা উপদেষ্টাদের দিয়ে ‘রাজুতে’ জড়ো করাবেন তার যত চ্যালা-চামুণ্ডাকে। সঙ্গে মাঠে নেমে যাবে ইউএসএআইডি’র ‘নিমক’ খাওয়া বুদ্ধিজীবীরা। তাদের সঙ্গে এনজিও ঘরানার নারীদেরও রাজপথে নামাবেন।
আন্তর্জাতিক বিশেষ মহল থেকে বলা হবে-‘দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তার সরকারের পতন হলে দেশ গভীর সংকটে পড়ে যাবে, সুতরাং যে কোনো মূল্যে তার সরকারের অবস্থান শক্ত করা প্রয়োজন’। প্রধান বিরোধী দলকে তার পক্ষে থাকার জন্য অনুরোধ করবেন (আপনারাই আগামীর সরকার টোপ দিয়ে)।
এর পর মাঠে নামাবেন র্যাডিক্যাল ইসলামিস্ট দলগুলোকে। তারা সেনাবাহিনীকে আগের মত চ্যালেঞ্জ দিতে না পারলেও এনার্কি ঘটাতে পারবে না, এমন নয়।
মঞ্জুরুল হক লিখেছেন, এসবেও কাজ না হলে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার ভান করে “ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে” বলে আবারও টাইম পারচেজ করবেন। ডিপ স্টেট নিজেদের বিপদ দেখলে পোষ্যদের কথা ভাবে না। জাস্ট নিজেদেরকে নিরাপদ জোনে সরিয়ে নেয়। ডিপ স্টেটকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারলে, তার শক্তির প্রধান উৎস সেনাবাহিনীকে আস্থায় রাখতে না পারলে, দেশে আরও একটা মব-ভায়োলেন্স তৈরি করতে ব্যর্থ হলে, পুলিশের শতভাগ সমর্থন হারালে, ব্যুরোক্র্যাটদের পদত্যাগ ঠেকাতে ব্যর্থ হলে জাস্ট সব ছেড়েছুড়ে চলে যাবেন। সে সময় একটি বারের জন্যেও পেছনে তাকাবেন না। সুতরাং ধরে নিন এখন ট্রেলার চলছে… আসলি মুভি আব ভি বাকি…। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বিমান বন্দরসহ সব গুরুত্বপূর্ন স্থাপনায় সশস্রবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছে যেকোন সহিংসতা- নাশকতা এড়াতে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারি ফয়েজ তৈয়্যব তার ফেইসবুকে লিখেছেন, ‘ মহম্মদ ইউনুস পদত্যাগ করবেন না। তবে তার ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ন গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অধ্যাপক ড. ইউনুসের দরকার আছে।’ এই বিশেষ সহকারি তৈয়ব আরো লিখেছেন- পাশাপাশি সেনাবাহিনীও রাজনীতিতে নাক গলাতে পারবেনা। তার কথায়- আজকের দুনিয়ায় কোনও সভ্য দেশের সেনাবাহিনী রাজনীতি করে না। তাই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বক্তব্যে সেনাপ্রধান জুরিডিকশনাল ক্যারেক্টনেস রক্ষা করতে পারেননি।
অবশ্য এক্ষেত্রে এ মন্তব্য করেই চতুর এই সহকারি আবার বলেছেন, তবে সেনাবাহীনিকে প্রাপ্য সম্মান দেখাতে হবে। সেনাবাহিনী প্রশ্নে হুট করে কিছু করা যাবে না, হঠকারি কিছু করা যাবে না। তেমনি ইনক্লুসিভনেসের নাম করে আওয়ামীলীগের পুনর্বাসনও চাওয়া যাবে না। সরাসরি আওয়ামী বিরোধীতা ও অত্যন্ত কৌশলে সশস্রবাহিনী ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার উজ- জামান সম্পর্কে সমালোচনা করতে ছাড়েননি তিনি।
সাধারণত: দেখা গেছে যে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে নির্বাচন দিতে চায়না, আর বেসামরিক কর্মকর্তা, রাজনৈতিক দলগুলো চায় একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করুক। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি হচ্ছে পুরো উল্টো। তারমানে সেই যে ২০২৪ এর আগষ্ট থেকে বাংলাদেশ উল্টোপথে হাঁটছে এখনো সে হাঁটা অব্যাহত রয়েছে।
#নুরুল ইসলাম আনসারি, লেখক, প্রাবন্ধিক।