বাংলাদেশ এক গভীর সংকটে। রাজনৈতিক দিক থেকে অনিশ্চয়তা, অর্থনীতিতে স্থবিরতা, আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চূড়ান্ত একঘরে হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি।
অথচ এই ভয়াবহ বাস্তবতায় ‘নির্বাচনের’ মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক- রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয়কে ইউনূস সরকার ব্যবহার করছে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার ঢাল হিসেবে।
কূটনৈতিক ব্যর্থতায় বাংলাদেশের চরম অবনমন
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে বিশেষ ট্রেড সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক আরোপ করেছে। পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও চাপ বাড়ছে।
মানবাধিকার, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর অসন্তোষ এখন প্রকাশ্য। অথচ সরকার মুখ বন্ধ করে, কূটনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় থেকে দেশকে একঘরে করে তুলেছে।
জঙ্গী তোষণ ও ইসলামিস্টদের নিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে বন্ধু হিসেবে পেয়েছে শুধুমাত্র পাকিস্তান ও তুরস্ককে। ষড়যন্ত্র, জঙ্গী উৎপাদন ও বিতরনকারি এ দুটি দেশও স্বার্থের বন্ধু।
অথচ বাংলাদেশ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার সম্ভাবনাময় অর্থনীতির একটি উজ্জ্বল নাম। এখন আমরা ক্রমেই সেই সম্ভাবনার বিপরীতে যাচ্ছি। অর্থনীতি ধ্বংসের পথে, জনগণের ঘাড়ে বোঝা মূল্যস্ফীতি লাগামহীন।
মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়ে গেছে। বিদ্যুৎ সংকট, লোডশেডিং, ব্যয়বহুল জীবনযাপন মানুষকে দমিয়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।
ইউনূস সরকারের অদক্ষতা ও নীতিহীনতার কারণে দেশের অর্থনীতি আজ রুগ্ন। শুধু অর্থনীতি নয়, এই সরকার মানুষের স্বপ্নও ভেঙে দিয়েছে। চাকরি নেই, নিরাপত্তা নেই, ভবিষ্যতের কোনো দিশা নেই।
নির্বাচন নয়, জনগণ এখন চায় শান্তিতে বাঁচতে। দেশ ও গণতন্ত্র রক্ষার সাথে নিরাপত্তা খুঁজছে মানুষ।
বৈষম্য নিরসনের মুলা ঝুলিয়ে এ দেশের তরুণ ছাত্র সমাজ ও সাধারণ জনগনকে রাজপথে টেনে আনতে সক্ষম হলেও সেই বৈষম্য আরো বেড়েছে বহুগুণ।
শেখ হাসিনা তথা আওয়ামীলীগের আমলে মানবাধিকার ছিলনা অভিযোগ তুলে মানুষকে খেপিয়েছিল। কিন্তু এখন যে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত সেটি বলার সাহসটুকু পর্যন্ত এ দেশের মানুষের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে।
সাংবাদিকতার পরাধীনতা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড করেছে। সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যম এমন চরম দুর্বিপাকে কখনো পড়েনি এই বাংলাদেশে।
সরকারের কোন সমালোচনা করলেই তাকে বা তাদেরকে আওয়ামীলীগের দোসর, ফ্যাসিবাদের দোসর এই ট্যাগ লাগিয়ে মব সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে। সেই মব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও কার্যক্ষেত্রে তা অনুপস্থিত।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামীল নিষিদ্ধ। অথচ এই আওয়ামীলীগের নেতৃত্বেই এই বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্ম হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধ- একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে হেন কোন অপকর্ম নেই যা এই সরকার করছেনা। জঙ্গী ও মব সন্ত্রাসের আশ্রয়- প্রশ্রয় ও নেতৃত্বদাতা, মেটিকুলাস ডিজাইনের গুরু নোবেল লরিয়েট ইউনুস এরই মধ্যে ১১ মাস পার করে ফেলেছেন।
কিন্তু যেসব সুন্দর সুন্দর কথা বলেছিলেন তিনি ও তার পারিষদবর্গ তার কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারেনি তারা। যেটি হয়েছে, তা হলো– ইউনুস ও তার গংয়ের অর্থনৈতিক উন্নতি যা একেবারে উল্লম্ফনীয় ভাবে।
দেশের মানুষতো বটেই বিশ্বের হেন কোন দেশ নেই যারা ইউনুসের কথিত অন্তবর্তী সরকারকে সমর্থন ও সাহায্য করতে রাজী আছে। যা আছে তা শুধু ওপরে ওপরে আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।
ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত অন্তত: ১১ টি দেশ সরকারিভাবে সফর করেছেন ড. ইউনুস সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। কিন্তু চরম লজ্জার বিষয় হলো — বিদেশে এ পর্যন্ত কোথাও কোন সরকারই তাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে সম্মানটুকু দেয়নি।
তার মানে তাকে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবেই মানছেন না তারা। কিন্তু তারপরও এই লাজ লজ্জাহীন এই লোকটি বিদেশে গিয়েছেন বার বার দেশকে অপমানিত করে।
এতসব ব্যর্থতা ঢাকতেই কি রোজার আগে তড়িঘড়ি নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দেয়া হলো ড. ইউনুসের পক্ষ থেকে? না কি সেনাবাহিনীকে খুশি রাখতে?
নাকি ইতিপূর্বে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার- উজ- জামানের দেওয়া সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন দিতে বাধ্য হচ্ছেন ইউনূস সরকার? — এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে বা আলোচনা করছেন কেউ কেউ। যে সরকারের সংবিধান সম্মত কোনো ভিত্তি নেই, যার ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা নেই, তারা কি জনগণের ভোট চায়? নাকি বিদেশীদের কাছে দায়মুক্তির সার্টিফিকেট চায়?
নির্বাচন বাংলাদেশে অনিশ্চিত– এটি নিশ্চিত করে বলা যায়। তাই যদি মেনেই নেই যে, নির্বাচন হবে। তবে জাতির প্রশ্ন এ কেমন ইনক্লুসিভ নির্বাচন
যেখানে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলকে বাইরে রেখে ‘ইনক্লুসিভ’ নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, সেটা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়।
বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, এনসিপিএই চরমপন্থী ও পাকিস্তানপন্থীদের নিয়ে যে জোট গঠন করা হয়েছে, তাতে নির্বাচনের চেহারা গণতান্ত্রিক নয়, বরং জঙ্গিবাদ-নির্ভর ।
নির্বাচন কি আদৌ হবে সে নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন মহলে। যদিওবা হয় তাহলে কি এই নির্বাচনের মাধ্যমে আবারও ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৯৬)-এর মতো একতরফা ভোটের ইতিহাস রচিত হতে চলেছে এমন প্রশ্নই দেখা দিয়েছে।
তবে বর্তমান সরকার বিরোধীদের মতে, প্রধানত আওয়ামীলীগ ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার আওয়ামীলীগের নীতি- আদর্শের সঙ্গে মতৈক্য পোষণ করেন এমন নাগরিকদের বক্তব্য হচ্ছে- এই অবৈধ- অনির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কোনো আপস নয়।
জাতি এখন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। সংবিধান, গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে, এই সরকারকে বিদায় জানানো অবশ্যক। তাদের মতে– যারা দেশের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দিচ্ছে, যারা গুম-খুনকে রুটিন করে তুলেছে, যারা সেনাবাহিনী, প্রশাসন, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে দখলদারিত্বের মডেলে চালাচ্ছে তাদের আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় থাকা উচিত নয়।
আওয়ামীলীগের নেতা- কর্মীদের স্পষ্ট বক্তব্য- দাবি একটাই। হটাও ইউনূস, বাঁচাও দেশ। প্রবাসী কয়েকজন আওয়ামীলীগের নেতা বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের চোখে এখন সবচেয়ে বড় নির্বাচন নয়, বরং স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই। জনগণ ভোট চায়, তবে এই মুহূর্তে তারা এই জালিম সরকার থেকে মুক্তি চায় ।
মুক্তি এই জালিম সরকারের হাত থেকে, মুক্তি দখলদারদের লেজুড়বৃত্তি থেকে। নতুন ভোটের আগে চাই নতুন পথ, নতুন যাত্রার আগে চাই নতুন সরকার নিরপেক্ষ ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ।
** নির্বাচনে ইউনুসীয় শর্ত।
নির্বাচন নিয়ে যত আলোচনা- সমালোচনাই হোক না কেন মেটিকুলাস ডিজাইনার ইউনুস তার ডিজাইনই বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। তবে নির্বাচন দেওয়া না দেওয়া নিয়ে তার নানা ষড়যন্ত্রের খেলা কিন্তু শেষ হয়নি।
মাত্র একদিন আগেই তিনি তার প্রেস সেক্রেটারি সফিকুল আলম ( যিনি ডাস্টবিন সফিক নামে পরিচিতি পেয়েছেন) এর মাধ্যমে এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বার্তা দিয়েছেন রাজনৈতিক দল ও জাতির কাছে।
এতে অনেকেই মনে করছেন বা ভাবতে পারেন যে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হবে। কিন্তু বিষয়টি মোটেই তা নয় বলে বোঝা যাচ্ছে। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার কথা জানিয়েছেন ড. ইউনুস তার প্রেস সেক্রেটারির মাধ্যমে গত ৯ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে।
অর্থাৎ বাকপটিয়সি ও প্রতারক ইউনুস কিন্তু এখানে চালাকি করে বলিয়েছেন যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি। যদি কোন কারনে বাধ্য হয়ে ডিসম্বরেই নির্বাচন দিতে হয় তাহলে তিনি যাতে বলতে পারেন যে, আমিতো বলেছিলাম ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে, সেক্ষেত্রে আমার দোষ কোথায়! অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে এমন বক্তব্য প্রচার করিয়েছেন তিনি তার একান্ত বশংবদ প্রেস সেক্রেটারির মাধ্যমে।
তাহলে নির্বাচন কখন সে প্রশ্ন থেকে যায়। সেক্ষেত্রে যদি আমরা একটু ইউনুসীয় বিভিন্ন বয়ান পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখবো– তিনি কখনো ২০২৬ এর জুনে, আবার কখনো রোজার আগে, কখনো রোজার পরে, কখনো এপ্রিলে, আবার লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেছেন ‘২৬ এর ফেব্রুয়ারির দিকে হতে পারে — এমন কিছু বক্তব্য প্রচার করা হয়েছে।
তবে সঠিক কোন দিন তারিখ বলা হয়নি। এভাবে নানা সময়ে নানা কূটকৌশলে তিনি জাতির সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছেন।
এদিকে গত ১০ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি মার্কিন নাগরিক অধ্যাপক আলী রিয়াজের সাথে এক বৈঠকে ড. ইউনুস জানিয়ে দিলেন — তিনটি শর্ত পূরণ হলে তবেই নির্বাচন হবে।
তিনি বলেছেন, আগামি বছর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে বলে লন্ডনে এক যৌথ বিবৃতিতে যে ঘোষণা এসেছিল তার বাস্তবায়ন হবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন বা জুলাই সনদের ভিত্তিতে।
তিনটি শর্ত হলো– সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে নিয়োগ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, ভবিষ্যতে ইচ্ছেমতো সংবিধান পরিবর্তন করা যাবেনা, নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন করার ব্যবস্থা রাখা।
তার মানে কি দাঁড়াচ্ছে? একদিকে গত ৯ জুলাই ড. ইউনুসের প্রেস সেক্রেটারি সফিকুল আলমের মাধ্যমে বলানো হলো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেয়ার। আবার তার দু’ দিন পরেই ইউনুস নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কতগুলো শর্ত জুড়ে দিলেন।
প্রশ্ন হলো– তিনি কে এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য? তিনি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে রচিত সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে শপথ নেবেন কিন্তু আবার ‘ রিসেট বাটন’ টিপে সবকিছু মুছে ফেলতে চান!
এমন দু: সাহস তাকে কে দিয়েছে? সংসদে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে সংবিধান সংশোধন/ পরিবর্তনের বিধান রয়েছে। যার এক্তিয়ার শুধুমাত্র সংসদের। রাজনৈতিক দলগুলোই তা সংসদের মাধ্যমে করতে পারে। একটি অনির্বাচিত, একটি অগণতান্ত্রিক সরকারের পদ দখলদার ইউনুস কিভাবে সংবিধানের ওপর হাত দেয়ার ধৃষ্টতা দেখায় সেটা ভেবে দেখতে হবে।
অসাংবিধানিক ক্ষমতা নিয়ে তিনি সংবিধান পরিবর্তন করতে উদ্ধত হয়েছেন। তারমানে তিনি বা তারা যা বলবেন সেগুলোই মানতে হবে? বাংলাদেশের জনগনের রক্তে গড়া সংবিধান তার মতো একজন প্রতারকের হাতে বন্দী বা কাটাছেঁড়া হতে থাকবে সেটি কখনোই এ দেশের জনগন মেনে নেবেনা।
তার উপর এক বিদেশি নাগরিক অধ্যাপক আলী রিয়াজ কিভাবে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়ে যান তাও মাথায় ঢোকে না।
তবে বাংলাদেশে নির্বাচন অনিশ্চিত। এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।
# ইশরাত জাহান, লেখিকা, নারী সংগঠক, প্রাবন্ধিক